মানুষের চোখ দুটো যখন সম্মুখেই স্থাপিত আর পায়ের পাতাও সামনের দিকেই প্রসারিত তখন বুঝতে হবে–মানুষের সম্মুখদৃষ্টি আর অগ্রগতিই ছিল বিধাতার অভিপ্রেত। কাজেই পিছুহঠা বিকলাঙ্গ অন্ধের অনাচার মাত্র।
বর্তমানে উৎকৃষ্টতর কিংবা যোগ্যতর কিছু না পেলে অথবা ভবিষ্যতে পাবার আশা বা বিশ্বাস না জাগলে কেউ অতীতকে পরিহার করে না। কাজেই পরিত্যক্ত অতীতের ভাব-চিন্তার সামগ্রীমাত্রই বর্তমান ভাব, চিন্তা ও কর্ম থেকে নিকৃষ্ট কিংবা অপূর্ণ। কেননা মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রয়াস মানুষের নৈপুণ্য বৃদ্ধি করছে–সামগ্রিকভাবে তার মানসিক ও বৈষয়িক জীবন প্রতি মুহূর্তে উৎকর্ষ লাভ করছে। এজন্যেই তো বলা হয়েছে অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। পুরোনো জীবনযাত্রার কোনো অবলম্বনই আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় না, চরম তাচ্ছিল্যে পরিহার করি সেসব, কেননা সেগুলো উপযোগ হারিয়েছে। অথচ পুরোনো কালের ভাব-চিন্তা-আদর্শ-বিশ্বাস সংস্কারেরই কেবল উপযোগ রয়ে গেল, নিরাসক্ত মনে এ বোধ ঠাই পায় না। কিন্তু আবেগপ্রবণ মনে এ বোধের প্রভাব অশেষ ও অনড়। তবু যুক্তিপ্রবণ বুদ্ধিজীবীর কাছে আবেদন করা চলে এই বলে যে,
ছিন্নমালার ভ্রষ্ট কুসুম ফিরে যাসনে কো কুড়াতে
ফুরায় যা–দে রে ফুরাতে
কেননা ওতে কল্যাণ নেই।
এখানে আইরিশ Revivalism-এর কথা কারো কারো মনে জাগতে পারে। ইংরেজের সৌভাগ্য ও পীড়নই আইরিশদের স্বাতন্ত্রকামী করেছিল। দুর্বলের স্বাতন্ত্র কামনা হীনমন্যতার এক পরোক্ষ প্রকাশ। যারা আত্মশক্তিতে আস্থাহীন অথচ মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যকামী তাদের মনেই স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবল হতে থাকে। এবং যেহেতু নিজে সামর্থ্যহীন তাই অতীত সামর্থ্যের সঞ্চয়কে সম্বল করে সে নিজেকে ভাবে ঋদ্ধ ও সম্মানিত। এখন আমার কিছু নেই বটে, কিন্তু কী না ছিল আমার এককালে–এমনি একটা বোধের আশ্রয়ে সে আত্মস্থ হতে চায়, জাগ্রত করতে চায় আত্মসম্মানবোধ। আসলে সে মনকেই চোখ ঠাওরায় এভাবে। কেননা তার মধ্যে সদাজাগ্রত আকাঙ ক্ষা ও উদ্যমই তাকে শক্তি দান করে মুক্তিলাভের–প্রেরণা দেয় সংগ্রামের। সে মনে করে–বুঝি এসব ঐতিহ্য-চেতনা ও স্বাতন্ত্র-বুদ্ধির দান। কিন্তু তা যে নয়, তার প্রমাণ আজকের প্রগতিশীল বিজ্ঞান ও যন্ত্রজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত হয়ে সেও টিকতে পারে না–পারে না এগুতে। সে বেঁচে আছে বর্তমানকে বরণ করেই, অতীতকে ধরে নয়।
স্বাতন্ত্রকেও তার স্বরূপে গ্রহণ করা উচিত। যোগ্যের উৎকর্ষই তার স্বাতন্ত্র। কেবল অযোগ্যরাই আত্মসংকোচনকে স্বাতন্ত্র মনে করে আত্মপ্রবোধ ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সবলের স্বাতন্ত্র আত্মপ্রসারে ও আত্মপ্রভাব বিস্তারে প্রবর্তনা দেয়। আর দুর্বলের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছোঁয়া ও প্রভাব এড়িয়ে চলার আগ্রহ জাগায়। দুর্বলের এ পদ্ধতি কেবল হীন ও নির্বোধের কাজেই প্রশংসনীয়।
কেউ কেউ য়ুরোপীয় রেনেসাঁসে রিভাইভেলিজমের লক্ষণ খুঁজে পান। রেনেসাঁস কোনো একদিনের ব্যাপার ছিল না। আড়াইশ বছরের পরিসরে তার উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। ইতিমধ্যে য়ুরোপে ভাঙা-গড়ার বহু ও বিচিত্র আন্দোলন ও ঘটনা ঘটে গেছে, ফ্লোরেন্সের লিও নার্ডো দা-ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) কেবল সৌন্দর্যপিপাসু চিত্রশিল্পী ছিলেন না; মনীষী, বিজ্ঞানী এবং ভাস্করও ছিলেন। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ছিলেন ভাস্কর ও স্থপতি। রাফেলও কেবল শিল্পী ছিলেন না, জীবন-জিজ্ঞাসুও ছিলেন। এই ফ্লোরেন্সেই জন্মেছিলেন তেরো শতকে কবি দান্তে ও চৌদ্ধ শতকে কবি পেত্রার্ক। পনেরো, ষোলো ও সতেরো শতকে নেদারল্যান্ডের মুক্তিসংগ্রাম কলম্বাস-ভাস্কো-ডা গামার সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কার ও অপরিমেয় ধনাগম, ফলে সামন্তসমাজে বেনে-বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব, কৃষক-বিদ্রোহ, মুদ্রারীতির প্রসার; যাজক ও শাসকের, সামন্ত ও বুর্জোয়ার বিরোধ, Inquisition-এর বিরুদ্ধে Huss ও মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে গণবিদ্রোহ, কোপারনিকাস-ব্রুনো গ্যালিলিওর উচ্চারিত তথ্য, ছাপাখানার প্রবর্তনে বিদ্যার বিস্তার, বাইজেনটাইন গ্রীক বিদ্বানদের য়ুরোপে পুনর্বাসন প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই ছিল রেনেসাঁসের মূলে।
এসব আর্থনতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনীতিক ও কলা-বিদ্যা-জ্ঞান-চিন্তাবিষয়ক আন্দোলন বিদ্রোহ-বিপ্লব –রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও রেভলিউশন –এ তিন শাখায় সংহত রূপ নিয়েছে ঐতিহাসিকের চোখে। এই পুনরুজ্জীবন, সংস্কার ও বিপ্লবের মূলে যে-প্রেরণা যে-উদ্যম ক্রিয়াশীল ছিল তা ছিল এক কথায় মুক্তি-অন্বেষা। পীড়ন থেকে, কুসংস্কার থেকে, বদ্ধচিত্ততা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অজ্ঞতা থেকে, দুর্বলতা থেকে, ভীরুতা থেকে মুক্তির অভিব্যক্ত উল্লাসের নাম রেনেসাস। সুতরাং এখানে রিভাইভেলিজমের দান কোথায়!
মুখ্যত মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর বাজেন্টাইন গ্রীকবিদ্বানেরা যখন য়ুরোপে ছড়িয়ে পড়েন, এবং টোল খুলে তারা যখন মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে বিদ্যাবিতরণ করতে থাকেন তখন শিক্ষার আলোপ্রাপ্ত চিত্তে যে জীবন-চেতনা জাগে, সে-চেতনায় তারা জগতের ও জীবনের নতুন রহস্য আবিষ্কার করে। নতুন দৃষ্টিতে খুঁজে পায় জগৎ ও জীবনের নতুন তাৎপর্য। জানার ও পাওয়ার সে-উল্লাসই তাদেরকে নতুন ভাব-চিন্তা-কর্মে প্রবর্তনা দেয়। উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে তারা প্রথমে গ্রীক পুরাণকেই গ্রহণ করে এবং এভাবে তারা জীবনের সৌন্দর্য ও আনন্দকে অভিব্যক্তি দান করতে থাকে। তাদের অনুভবে তখন তাদের সমকালীন পরিবেষ্টনী তুচ্ছ ও সাময়িক। তাই তাঁদের স্বপ্নের, কল্পনার ও আর্দশের জগৎ রচনার উপকরণ হয়েছে প্যাগান ও খ্রীস্টীয় পুরাণ। এই রোমান্টিক জগৎ ও জীবন-দৃষ্টিতে যে-কৌতূহল, যে-জিজ্ঞাসা, যে-সৌন্দর্য-চেতনা, যে-শিল্পবোধ, যে-রূপানুরাগ ও যে-আত্মসচেতনতা সুপ্রকট তা নবলব্ধ চেতনা, নতুন-জাগা আকাঙ্ক্ষা, নতুন পাওয়া উদ্যম ও মুক্তি-অন্বেষারই অভিব্যক্তি। কাজেই তা প্যাগান-পুরাণ-প্রীতির ফল নয়। গ্রীক পুরাণের অপরিমেয় ও অনবরত ব্যবহার দৃষ্টিকে এতই বিভ্রান্ত করে যে আমরা অবলম্বনকে কারণ ও উপকরণকে প্রেরণার উৎস ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এভাবে উপায়কে মনে করেছি কারণ বলে আর অবলম্বনকে জেনেছি লক্ষ্য বলে। প্রাণের প্রেরণা ও চেতনার দান রইল অস্বীকৃত ও অগোচর।