.
০২.
বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃভূমি ছিল ফেনী মহকুমার পরশুরাম থানার অন্তর্গত উত্তরগুথুমা গাঁ। তার প্রপিতামহ তমিজুদ্দীন চৌধুরী ওর্ষে তমিজুদ্দিন মুন্সী ছিলেন নোয়াখালী আদালতের ফারসিনবিশ উকিল। প্রমাতামহ আমজাদ আলি ছিলেন ইংরেজি জানা সরকারি চাকুরে–চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের প্রথমে পেশকার ও পরে Personal assistant. তমিজুদ্দীন মুন্সীর বজলুর রহিম, ফজলুল করিম, আব্দুল ওদুদ, শামসুদ্দীন প্রভৃতি পাঁচটি পুত্ৰই উচ্চ ইংরেজি শিক্ষালাভ করে চট্টগ্রাম বিভাগের মুসলিম সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং এ পরিবার প্রখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠে। আমজাদ আলির জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল আজিজই নোয়াখালী জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট। এই দুই পরিবারের অনেকেই পদস্থ সরকারি কর্মচারী, ব্যবহারজীবী ও জননেতা হিসেবে সরকারি খেতাব এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেন। আবদুল আজিজ বিয়ে করেন তমিজুদ্দিন মুন্সীর মেয়ে এবং আমজাদ আলির কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয় বজলুর রহিমের। তমিজুদ্দিন মুন্সীর প্রথম পুত্র ফজলুল করিমের পুত্র নুরুল্লাহ চৌধুরী। নুরুল্লাহ চৌধুরী বিয়ে করেন আমজাদ আলির পুত্র খান বাহাদুর আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে। বাহার সাহেব ও বেগম শামসুন। নাহার মাহমুদ এঁদেরই সন্তান। বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃকুলে উচ্চশিক্ষা ও ঐশ্বর্য দু-ই ছিল। বাহার-নাহার এই পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্যুতি ও ঐশ্বর্যের প্রসাদের মধ্যে লালিত।
তা ছাড়া বাহার ও নাহার আরো একটি বিশেষ পরিবেশ পেয়েছিলেন। তা দুর্ভাগ্য দিয়ে শুরু বটে কিন্তু সৌভাগ্যের সম্ভাবনাও সূচিত হয় সে-পথেই। খান বাহাদুর আবদুল আজিজ অপুত্রক ছিলেন। তাঁর ছিল পাঁচটি কন্যা। আশ্চর্য, অতি অল্প সময়েই তিন কন্যার হয় মৃত্যু এবং দুই কন্যা হন বিধবা। বাহার সাহেবের মা ছিলেন জ্যেষ্ঠা কন্যা। তিনি যখন বিধবা হন তখন তার বয়স বিশের বেশি নয়। এবং বাহার তিন বছরের আর নাহারের বয়স তখন দেড় বছর। এসময় তাদের মা-খালারা এবং নানা-নানী সব জীবিত এবং সম্ভবত খালারাও অবিবাহিতা। আবদুল আজিজ সাহেব চট্টগ্রাম বিভাগের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন এবং চট্টগ্রাম শহরেই স্থায়ীভাবে বাস করতেন। এখানেই পিতৃহীন বাহার-নাহার নানা-নানী, মা-খালাদের চোখের মণিরূপে পরম আদরযত্নে লালিত হন। খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ জনহিতৈষী শিক্ষাবিস্তারকামী উদার-হৃদয় ও সাহিত্য-প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কাব্যচর্চাও করেছিলেন। সমকালীন বিরুদ্ধ সামাজিক পরিবেশেও তিনি কন্যাদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তারই ঘরে তারই তত্ত্বাবধানে বাহার-নাহার লালন ও শিক্ষা পান। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে বাহার এবং ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে নাহারের জন্ম।
.
০৩.
শিশু স্বাস্থ্যবান হলেই চঞ্চল হয়, আর শৈশবের চাঞ্চল্যের অপর নাম দুরন্তপনা। এবং দুরন্ত ছেলেই বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে ক্রীড়াপ্রিয় হয়। আবার ক্রীড়াপ্রিয় মানুষ বন্ধু ও সঙ্গ-সুখকামী হয়। বাহার সাহেবের আবাল্য এসব বৈশিষ্ট্য ছিল। আজীবন আড্ডাবাজ থাকার মূলে রয়েছে এই মানসচেতনা। খেলোয়াড়েরা সাধারণত পড়ুয়া ছাত্র হয় না। বাহার সাহেব ছিলেন মাঝারি ছাত্র। বাড়ির পাশের চট্টগ্রাম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আই-এসসি পাস করে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন–কিন্তু এ কর্ম আড্ডাবাজ ছেলের জন্য নয়, তাই চট্টগ্রাম কলেজে আরবিতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়তে থাকেন। পরীক্ষার সময় কিন্তু অনার্স পরীক্ষা দেননি। বিএ পাস করার পর তাঁর শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত হয়।
.
০৪.
চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী তরুণদের কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। অনন্ত সিং তাঁদের অন্যতম। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবে তাঁর সমর্থন ছিল না–তিনি নিয়মতান্ত্রিক-আন্দোলন সাফল্যে আস্থাবান ছিলেন।
তাঁর জীবনে বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব কখনো গম্ভীর হতে পায়নি। তাঁর পারিবারিক প্রভাবই তার চরিত্র নির্মাণ ও জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। নানা-নানী ও মা-খালাদের থেকে তিনি দুটো সম্পদ লাভ করেছিলেন–একটি সাহিত্য-প্রীতি এবং অপরটি নৈতিক-চেতনা। তাঁর জীবনে নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। ধর্মবুদ্ধি, আদর্শবাদ ও উদারতার সমন্বয় ঘটেছিল এ পরিবারের পরিজনদের চরিত্রে। বাহার সাহেবের মধ্যে আমরা এসব দুর্লভ গুণের উত্তরাধিকার প্রত্যক্ষ করি। খেলোয়াড় ও আড্ডাবাজ বাহারের আদর্শবাদ ছিল অনাবিল ও অটল, নৈতিক চেতনা ছিল প্রবল। তাই এই প্রাণবন্ত প্রবল পুরুষের জীবনের কোনো নৈতিক উজ্জ্বলতা ছিল না, ছিল না কোনো কাপট্য বা মিথ্যাচার। আদর্শ চরিত্র ও মহৎ জীবনের অনুধ্যানেই তাঁর জীবন কেটেছে। তাঁর রচনাবলীর অধিকাংশই তাই চারিত্র্যপূজার ও কীর্তিমান পুরুষের কর্মের অনুধ্যানের নিদর্শন।
ধর্মভাব ও আদর্শবাদ তাঁকে অতীত ও বর্তমানের মুসলিম জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র- চিন্তায় উৎসাহী করেছে। তাঁর স্বধর্ম ও স্বধর্মীপ্রীতি বিধর্মী-বিদ্বেষ জাগায়নি। তাই তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নিন্দা চিরকালই অসূয়ার হুল-মুক্ত ছিল। তার হিং ও হালিম তাই বিদ্বিষ্টমনের বিষ ছড়ায়নি, রসিকজনের চিত্তে কেবল রসই সিঞ্চিত করেছিল। গাল যে খেলো আর গাল যে দিল–উভয়েই রইল পাঠকের উচ্চহাস্যের আধার হয়ে। হিং ও হালিমে কলমের জোর যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনি কলমের পশ্চাতে যেমন ক্রিয়াশীল ছিল, তার প্রসারও হত আভাসিত। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর নিন্দা গালিও যে অশ্লীলতা-মুক্ত হতে পারে, তা বাহার সাহেব নতুন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন।