বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন–লোক-শিক্ষা, লোকোপকার কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ পাপ। হৃদয়বান মানববাদীরাও বলেন যেখানে মানুষ আজো অনিকেত, আজো অভুক্ত, আজো দাসত্বে পশুপায়, আজো অশিক্ষায় পঙ্গু, আজো অজ্ঞানে অন্ধ, আজো অবিদ্যায় অবোধ, আজো পীড়নে পৃষ্ঠ, আজো শোষণে অস্থিসার, আজো অকালমৃত্যুর শিকার, আজো রুদ্ধকণ্ঠ, আজো বদ্ধহস্ত; সেখানে সৌন্দর্য সৃষ্টি পাপ– অমানুষিক অনাচার দানবিক নির্মমতা।
কিন্তু এ নিন্দা ও বিক্ষোভ অবিবেচনাপ্রসূত। কেননা জীবনে যাঁরা অবাধসুখ ও অপরিমেয় সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন তাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা হবে আনন্দের জন্যেই অর্থাৎ আনন্দলোক নির্মাণ লক্ষ্যে তাঁরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করবেন। বাধা পেলে বরং লেখনী ত্যাগ করবেন, কিন্তু অন্তরে প্রেরণা নেই বলেই গণসাহিত্য সৃষ্টি করতে কখনো পারবেন না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। এ শ্রেণীর কোনো কোনো মানববাদী গণ-সগ্রামের সৈনিকরূপে মসীযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
ব্যক্তিগত জীবনে যেমন পীড়ন পেলে প্রতিকার-প্ৰয়াস জাগে তেমনি সামাজিক ঔপনিবেশিক, আর্থিক ও কায়িক পীড়ন মুক্তির জন্যে সগ্রাম না করে অন্য পক্ষের উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লিখিয়ে-আঁকিয়েরাও তো ঘা-খাওয়া মানুষ, তারাও তো আর্থিক-সামাজিক-মানসিক অনেক ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত। কাজেই তাদের নিজেদের জন্যেও মুক্তিসংগ্রাম প্রয়োজন। মনোবল থেকেই আসে বাহুবল, কাজেই লেখনী মাধ্যমে গণমনে মনোবল জাগানো, চোখ খুলে দেয়া, চেতনা সঞ্চার করা তাঁদেরও গরজ। কারণ এক্ষেত্রে সাফল্যের একমাত্র উপায় হচ্ছে জনমত গঠন তথা গণশক্তি প্রয়োগ। এ হচ্ছে সামাজিক তথা যৌথ কর্ম। একক মানুষের দায়িত্ব কেবল সভ ঘক্তির অনুগত্যে সাড়া দেওয়া। অবশ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকও বুর্জোয়া প্রলোভনে লক্ষচ্যুত হয়ে স্বস্বার্থে সুখ-সুবিধা লাভের লোভে দায়িত্ব এড়িয়ে কর্তব্য-ভ্রষ্ট হয়ে অথবা নিছক মানস-প্রবণতা বশে জুটে যান নিরাপদ নান্দনিক কলার চর্চায়। এদের কেউ কেউ সরকারি শিরোপারও উমেদার। এঁরা স্বশ্রেণীদ্রোহী চরিত্রহীন। এবং প্রয়োজন ও প্রতিবেশ চেতনাহীন। মধ্যবিত্তশ্রেণীর কোনো কোনো লিখিয়ে কৃপার ও ক্ষমার পাত্র। কেননা তারা জানেন না তারা কী লিখছেন আর কেন লিখছেন। এভাবে মধ্যবিত্ত সমাজের লিখিয়েদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। একদল যথার্থ সংবেদনশীল, দায়িত্ব-সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠ সগ্রামব্রতী; এঁরাই জনগণের আশা-আশ্বাসের অবলম্বন। এঁরা সরকার-শত্রু। আর একদল আছেন সরকার-ঘেঁষা–এরা সুবিধাবাদী-স্বার্থবাজ। এরা গণ-শত্রু। তাই ঘৃণ্য। শেষ দল সরকার-ভীরু। এরা গা বাঁচিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশী। এরা কৃপার পাত্র।
কাজেই যতদিন পর্যন্ত কলাকৈবল্যরস উপভোগ করার অবস্থা ও সামর্থ্য সর্বমানবে সম্ভব না হচ্ছে ততদিন এই কেজো–এই বৈষয়িক–এই বাস্তব জীবনের চাহিদা-সর্বস্ব গণ-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন থাকবে।
অতএব সাহিত্যের দুইরূপ– দুইতত্ত্ব-দুইধারা এবং দুটোই রসময়; একটি কেবল উপভোগের জন্যে আর একটি নিছক উপলব্ধির জন্যে। একটির রস হয়তো যথার্থই মধুর, অপরটি ভিন্ন নামে কষ– যা কলিজা-নিঃসৃত এবং প্রথমে লাল ও পরে কালো।
হবীবুল্লাহ বাহার স্মরণে
০১.
প্রথমে চট্টগ্রামে, মধ্যে কোলকাতায় এবং পরে ঢাকায় বাহার ছিল একটি প্রিয় নাম। প্রিয়জনের উচ্চারিত নাম চিত্তে একপ্রকার প্রসন্নতা আনে। বাহারও ছিল তেমন একটি মধুর ধ্বনি।
সুদীর্ঘ সুঠাম শ্যামল সুপুরুষ বাহার সাহেবের আঙ্গিক লাবণ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল তার অন্তরের সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য। আবাল্য তিনি ছিলেন দেহে-মনে সুস্থ, সুন্দর ও প্রাণবান। তিনি অন্যের অন্তরের স্পর্শ পেতে যেমন চাইতেন, তেমনি নিজের অন্তরও মেলে ধরতেন অন্যের কাছে। তাঁর সঙ্গ-প্রিয়তা তাঁকে করেছিল বাকপটু, বন্ধুবৎসল, অকপট ও পরার্থপর। তার এই মানস-প্রবণতা বা চারিত্রিক গুণই তাঁকে করেছিল মজলিশি লোক ও আড্ডাবাজ। তাঁর জীবনে বৈচিত্র্য এবং ব্যপ্তিও আসে হয়তো এই সঙ্গ-সুখ প্রবণতা থেকেই। খেলার মাঠে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সাহিত্যের আসরে ও রাজনীতিক মঞ্চে তাঁর ছিল সমান আকর্ষণ, পাওয়া যেত তাকে সর্বত্র। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা বা বৃত্তি ছিল না বলে তিনি সমান উৎসাহে যোগ দিতে পেরেছেন সামাজিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মে ও খেলাধুলায়। ক্রীড়া ও কর্ম দু-ই তাঁর কাছে সমান ছিল। তাঁর প্রাণময়তা ও আনন্দিত জীবনের উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে তার সব ভাব-চিন্তা ও কর্মে। বাহার সাহেবের জীবন খেলা দিয়ে শুরু এবং সেবা দিয়ে শেষ। প্রথম জীবনে ক্রীড়ানৈপুণ্য এবং পরবর্তী জীবনে বাকপটুতাই তাকে জনপ্রিয় করে। তুচ্ছ কথাকেও রসিয়ে রসিয়ে বলে বা লিখে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার আশ্চর্য জাদু ছিল তার আয়ত্তে। কারো নিন্দায় বা প্রশংসায় তিনি সমান মুখর থাকতেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল আসূয়ামুক্ত ও স্বার্থবুদ্ধিবিহীন, তাই এ সব নিন্দা-প্রশংসায় তাঁর বিদ্বেষ বা অনুগ্রহ লোভ ছিল না। ফলে তা হত অনাবিল উপভোগ্য আড্ডা-রস।