জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য-চেতনা এবং স্বাতন্ত্র-সাধনা প্রবল। হয়ে উঠেছে। সুন্দরের ও আনন্দের আয়োজনে ও উপভোগে স্বাতন্ত্র্য-চেতনা নিরপেক্ষ কানে অদ্ভুত শোনায় বটে, কিন্তু আজ এও সত্য ও স্বাভাবিক হতে চলেছে। এতকাল আমরা জানতাম শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে রসিকের রুচি ও বোধের মাত্রাভেদ আছে। কিন্তু স্বাতন্ত্র যে আছে, তা ইদানীং জানছি।
কিন্তু এ স্বাতন্ত্র কোন্ তাৎপর্যে প্রযুক্ত তা আমরা জানিনে। যে-কোনো কলা-স্রষ্টার ব্যক্তিগত বোধ-বুদ্ধি, রুচি-সংস্কৃতি, মন-মনন ও চেতনার কথা জীবন-দৃষ্টির প্রসূন। সে কারণে প্রত্যেক শিল্পীর সৃষ্টি স্বতন্ত্র অর্থাৎ অনন্য ও মৌলিক। এ অর্থে সাহিত্যে জাতিগত কিংবা দেশগত স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে না, পারে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য।
আবার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনগত ঐক্য থাকলে, রূপগত অর্থাৎ আঙ্গিকগত অনৈক্য স্বাতন্ত্র্য দান করে না। যেমন জুতা কিংবা পাজামা প্রত্যেকেই তার পায়ের ও গায়ের মাপে তৈরি করায়, তাতে কিন্তু জুতো বা পাজামা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে না। সাহিত্য-সংগীত-চিত্র-নৃত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির আবেদন সর্বজনীন। কেননা এগুলো মনের এক নিরূপ চাহিদা পূরণ করে, চেতনার এক মানবিক পিপাসা মিটায়। এগুলো কলা-চেতনার সৌন্দর্যময় ও আনন্দময় অভিব্যক্তি। এজন্যে প্রাত্যহিক জীবনের স্থূল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে এগুলোর স্থিতি। চিত্তে বিশেষ এক চেতনা বা চিত্তবৃত্তি না জাগলে অথবা না থাকলে এগুলোর কোনো আবেদন অনুভব কিংবা এগুলোর অভাববোধ করা সম্ভব হয় না। কাজেই অনুভবের এই বিশেষক্ষেত্রে দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম না-থাকারই কথা।
যেহেতু এসব কলার আধার-নিরপেক্ষ অবয়ব নেই, সেজন্যে এগুলোর আধার ভেদ নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আধার ভেদে আধেয় রূপ বদলায়, গুণ বদলায় না। কাজেই দেশ-কাল ও নামভেদ থাকলেও সাহিত্যে আর কোনোরূপ স্বাতন্ত্র সম্ভব নয়। এবার দৃষ্টান্ত নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করা যাক।
প্রথমত, ধরা যাক জাতীয় সঙ্গীত ও স্বদেশ-স্বজাতি-প্রীতিমূলক গান ও কবিতা। এগুলো সবদেশের সবজাতের লোকই রচনা করে। তাতে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বক্তব্য থাকে অভিন্ন। কেবল দেশের নামভেদ থাকে মাত্র। ওটি বদল করে দিলে সর্বজনীন ও সর্বকালিক অনুভূতির বাহন হয় সেই গান বা কবিতা। নাটক-উপন্যাস-গল্পের ক্ষেত্রেও আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন যেহেতু অভিন্ন, পরিবেশ ও পাত্র-পাত্রীর নাম পালটে দিলে তা যে-কোনো দেশের মানুষের জীবনে চেতনার চিত্র হয়ে উঠতে পারে। তেমনি নৈতিক-সামাজিক জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধীয় রচনায়ও ব্যক্তিভেদে মতাদর্শের পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু দেশভেদে প্রয়োজন ও ফল ভেদ হতে পারে না।
প্রেম কিংবা পীড়ন, লোভ কিংবা অসূয়া, ক্রোধ কিংবা সহিষ্ণুতা, ক্ষমা কিংবা প্রতিহিংসা, আনুগত্য কিংবা কৃতঘ্নতা প্রভৃতি জৈব বৃত্তি-প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেশভেদে আলাদা হয় না, ব্যক্তিভেদে মাত্রার তারতম্য ঘটে কেবল।
অতএব যথার্থ সাহিত্য-রস দেশ-কালের ঊর্ধ্বে সর্বমানবিক। কেবল প্রচার সাহিত্যেরই দেশ কাল ও জাত-ধর্ম আছে। বলাবাহুল্য সংস্কৃতিবান কোনো মানুষ তা রচনাও করে না, পড়েও না এবং সাহিত্য বলে স্বীকারও করে না। সৎ-সাহিত্য মানুষকে ভাবায়, পরিশ্রুত করে চিত্তবৃত্তি এবং অনুভবের জগৎ করে প্রসারিত। এক-একটি মহৎ সৃষ্টি পাঠকের চেতনায় নতুন ভুবন রচনা করে। এক-একটি মহৎ কথার অনুভবে পাঠক তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে। তেমন কথায় ঘটে জীবনবোধের উন্নয়ন ও আত্মার স্বাধীন জগতে উত্তরণ। তেমন গ্রন্থ বিদেশীর-বিজাতির কিংবা বিধর্মীর রচনা বলে পরিহার করলে জীবনের আশীর্বাদ ও প্রসাদ থেকেই কেবল নিজেকে বঞ্চিত রাখা হয়, রোধ করা হয় নিজের অগ্রগতি। মানুষের চেতনার শ্রেষ্ঠ প্রসূন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-অনুভূতি বর্জনের দুর্বুদ্ধি যার মনে বাসা বাঁধে, সেও কি শিক্ষিত!
সাহিত্য-শিল্পাদি কলার ক্ষেত্রে অন্তত স্বাতন্ত্র-চিন্তা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। এখানে স্বাতন্ত্র্য নয়, সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানই কাম্য। তা ছাড়া এগুলো যখন বৈষয়িক নয়, মানসিক এবং সাধারণের নয়, কেবল বিশেষেরই চর্চার বিষয় তখন সহিষ্ণুতাই শোভন। এক্ষেত্রে সাড়ে পাঁচশ বছর আগেকার এক মনীষীর বাণী আমাদের হয়তো দিশা দিতে পারে :
Love the truth. Let others have their truth and the truth shall prevail. (Jan Huss of Bohemia)
এ সূত্রে গ্যটের বাণী স্মরণ করেও আমরা হয়তো চক্ষুষ্মান হতে পারি :
National literature is now rather and unmeaning term; the epoch of world literature is at hand and each one must try to hasten its approach.
তা ছাড়া বৈষয়িক জীবনেই যখন স্বস্বার্থে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় ও গাঢ় করবার প্রয়াসী, তখন মানসিক-জীবনেই বা স্বাতন্ত্র্য কামনা করে দীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করব কেন!
সাহিত্যের দ্বিতত্ত্ব
মানুষ তার পরিবেষ্টনীর আনন্দ ও যন্ত্রণা, সম্পদ ও সমস্যার মধ্যেই বাঁচে। এজন্যেই দেশ-কাল নিরপেক্ষ জীবনানুভূতি নেই। তাই বলে প্রতিবেশ আহৃত সব অনুভূতি সবহৃদয়ে সমান গুরুত্ব পায় না। বিদ্যা-বুদ্ধি-বোধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, রুচি-সংস্কৃতি ও মানস-প্রবণতার আনুপাতিক প্রভাবও অনুভবকে লঘু-গুরু করে। ফলে একের কাছে যা অসহ্য গুরুতর বা চাঞ্চল্যকর, অপরের কাছে তা নিতান্ত তুচ্ছ।