সে জীবনের ও মানসের রূপায়ণ ঘটে তার সাহিত্যে ও সঙ্গীতে তার নৃত্যে ও চিত্রে, তার দর্শনে ও অধ্যাত্মচিন্তায়, তার জীবন-ভাবনায় ও জীবিকা নির্বাচনে, তার সমাজবোধে ও নৈতিক চেতনায়, তার ধর্ম ভাবে ও রাষ্ট্রিক জীবনে।
এই দেশের নদী-নালা-হাওরের প্রভাব তাকে কখনো করেছে উদাসী, তখন তার বিবাগী মন ও দেহকে ভেবেছে অকুল নীরে মন-পবনের নৌকা বলে। আবার কখনো করেছে সংগ্রামী। পদ্মা-মেঘনা ব্রহ্মপুত্রের তীরবাসী মানুষ প্রকৃতি ও প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেই বাঁচে। বাউল-ভাটিয়ালী-ভাবাইয়া-হাপু-জাগ-জারি-সারি গানেই তাই তার জগৎ ও জীবনচেতনা অভিব্যক্ত। তার পারত্রিক চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে পীর, মুর্শিদ ও দরগাহ। তার অধ্যাত্মসাধনার অবলম্বন হয়েছে যোগ ও জিকির। তার জাগতিক জীবন-ভাবনায় নিয়ম ও নিয়তির বাধা তাকে কখনো করেছে উদ্বিগ্ন, কখনো করেছে উদ্বেল, আবার কখনো করেছে বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহী। চাঁদ বেহুলার কাহিনীতে ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রামের গীতিকায় রয়েছে তার সাক্ষ্য। আমাদের একালের সৎসাহিত্যেও রয়েছে স্বদেশের ও স্বজাতির সে-পরিচয়। বাঙলার গদ্য-পদ্য রচনায় গ্রাম-বাঙলার প্রকৃতি ও মানুষ সুচিত্রিত এবং জীবন ও জীবিকার ধ্যান-ধারণা সুপরিব্যক্ত। আরও রয়েছে বিশ্বাস সংস্কার-দুষ্ট পীড়িত, শোষিত ও দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট বিপর্যস্ত জীবনের আলেখ্য এবং পীর-দরগাহ-সংপৃক্ত জীবনচরিত্র।
অনেক তরুণ লেখকের রচনা প্রপীড়িত শোষিত মূক মানুষের জীবনের মর্মবেদনার ও জীবন যন্ত্রণার বর্ণনায় মুখর।
আমাদের শিক্ষিতের সংখ্যা আজও কম। কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা শিক্ষিত লোকের তুলনায় আরো কম। তাছাড়া দেশ-কাল ও জনজীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় তুলে ধরার যোগ্যতা থাকা চাই শিল্পীদের। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালো না বাসলে তার পরিচয় জানা সম্ভব নয়। মানুষকে সত্যই ভালোবাসেন তেমন লেখকও আমাদের বেশি নেই। এসব কারণে আমাদের দেশ-কাল মানুষের সামগ্রিক পরিচয়–তাদের বিশিষ্টতা আজো সাহিত্যে তেমন পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি।
সাহিত্যে স্বাতন্ত্র
স্বাতন্ত্র্য আজকাল একটি মুখরোচক ও শ্রোত্ররসায়ন চালু কথা। মানুষ ভাবে কম এবং পরের মুখে ঝাল খাওয়ায় অভ্যস্ত, আর কানকথা শুনতে উৎসুক, এমনকি কানকথায় কান ভার করতেও তার দ্বিধা নেই। তাই চলতি বুলির জনপ্রিয়তা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। চলতি কথার প্রভাবও গভীর এবং ব্যাপক। এর প্রভাব ভালো-মন্দ, আবেগ-উদ্বেগ, আনন্দ-বেদনা, আশা-হতাশা, সাহস-ভীরুতা, উৎসাহ-নৈরাশ্য, উত্তেজনা-ঔদাসীন্য প্রভৃতি যে-কোনো ভাব মানবমনে জিইয়ে রাখতে সমর্থ। ফলে এর থেকে লাভের লোভ ও ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো যায় না।
স্বাতন্ত্র্য কথাটিও এখন একটি জনপ্রিয় চলতি বুলি! রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, সামাজিক স্বাতন্ত্র, ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র, সাহিত্যে স্বাতন্ত্র প্রভৃতি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রায় শতেক স্বাতন্ত্রের বেড়ায় আমরা নিজেদের বদ্ধ করছি। দেখে-শুনে মনে হয় জগতে স্বাতন্ত্র গৌরবের মতো গৌরব নেই। স্বাতন্ত্রের অনুশীলন কর, তাহলেই ঘুচবে সব দুঃখ, মিটবে সব অভাব। ইরি ধানের মতো স্বাতন্ত্রের চাষে যে ফলন তার যেন তুলনা নেই।
ঘরে যারা এভাবে বিভেদের বীজ বুনে চলেছে, তারাই আবার UNO-এর প্রেক্ষা- মঞ্চে বিশ্বমানবের বিশ্বরাষ্ট্রের সংহতি ও ঐক্যের বাণী কপচায়। নিবর্ণ ও নির্বিশেষ মনুষ্যসমাজের প্রচারক যাঁরা, তাঁরা বৈষম্যের ব্যবধান জিইয়ে রাখার উপায় উদ্ভাবনেও উৎসাহী। সত্যিই মানুষ বড় বিচিত্র ও অদ্ভুত প্রাণী। মুখে তার প্রীতি ও মৈত্রীর বাণী, হাতে তার মারণাস্ত্র। সে এক হাতে কাড়ে, আর এক হাতে বাহবা ললাটে।
আবাল্য ম্যাকিয়াভেলীকে একজন সুন্দর শয়তান বলে জেনেছি। কিন্তু আজকাল যেন তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে মনে হয় মানব-প্রকৃতির এতবড় ব্যাখ্যাতা বুঝি আর দ্বিতীয়টি নেই। তার উচ্চারিত তত্ত্ব যে চিরন্তন ও চর্চার বিষয় হয়ে থাকবে তা হয়তো তিনিও জানতেন না। তিনি বলেছেন– A Prince must know how to play at once man and beast, lion and fox. He neither should nor can keep his word, when to do so, will turn against him…I venture to maintain that it is very disadvantageous always to be honest, useful, on the other hand to appear pious and faithful, humane and devout. Nothing is more useful than the appearance of virtue.
আজকের দিনের রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রনায়কেরা এই নীতি অবিচল নিষ্ঠায় মেনে চলেছেন। প্রজার আনুগত্য লাভের সহায়ক হিসেবে ধর্মের বুলি কপচানো এবং প্রবল পক্ষের ধর্মমতকে সমর্থন করাও সরকারের পক্ষে আবশ্যিক বলে জানতেন ম্যাকিয়াভেলী। বিশ্বের অনুন্নত দেশের কোনো কোনো সরকার তাও আক্ষরিকভাবে মানে এবং নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত শাসন-শোষণের সুযোগ পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণের, গোত্রের ও ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বুলি। দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষ করে আমেরিকায়, আফ্রিকায় ও অস্ট্রেলিয়ায় আজ এটিও শাসন-শোষণের একটি ফলপ্রসূ কৌশল ও মোক্ষম উপায়রূপে বিবেচিত, প্রযুক্ত ও প্রমাণিত। ফলে দুনিয়ার সর্বত্র সরকারের পরোক্ষ প্ররোচনায় আজ স্বাতন্ত্র-সাধনা দ্রুত প্রসার লাভ করছে। রোমকদের সেই Divide and Rule নীতি আজো উপযোগ হারায়নি, বরং তার গুরুত্ব বেড়েছে।