ভাষার ক্ষেত্রে গল্প-উপন্যাস লেখকদের কেউ বুলির ব্যবহারে উৎসুক, কেউ আরবি–ফারসি শব্দ প্রয়োগে আগ্রহশীল, কেউবা নতুন শব্দ গঠনে তৎপর, কারো বা লৌকিক Idiom-এ বেজায় আকর্ষণ।
বুলির সতর্ক ও সুষম ব্যবহারে উৎসুক দেখি সৃজনশীল প্রগতিবাদী লেখকদের। বুলির যথেচ্ছ ব্যবহারে আগ্রহ রয়েছে স্বাতন্ত্রকামী লিখিয়েদের আরবি–ফারসি শব্দের প্রতি গভীর মমতা আছে আরব-ইরান প্রিয় প্যান-ইসলামী তমদুনপন্থীদের। কিন্তু কবিতা ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে দুই-একজন ছাড়া সবাই চলতি রীতির ও চালু বাঙলা শব্দ সম্পদের প্রয়োগে অভ্যস্ত। দশ বছর আগেকার মোহ ও মূঢ়তা এখন আর কোথাও তেমন প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে না।
তবু সাহিত্যিকের শক্তিভেদে ভাষায় শব্দের অপপ্রয়োগ ও ভঙ্গির ত্রুটি প্রায়ই দৃশ্যমান। জ্ঞান-বিদ্যা-মন-রুচি অনুসারে রূপপ্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেউ দেশী ঐতিহ্যে, কেউ স্বধর্মীর বিদেশী পুরাণে, কিংবদন্তিতে ও ইতিহাসে আশ্রয় খোঁজেন এবং অন্যেরা প্রয়োজনমতো পৃথিবীর যে- কোনো দেশের বা জাতির পুরাণ, কিংবদন্তি ও ইতিহাসের সহায়তা গ্রহণে উৎসুক। এর কারণ একশ্রেণীর লেখক স্থানিক জাতীয়তায়, আর এক দলের লেখক ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখেন এবং তৃতীয় দল উদারচিত্তে মানবিক প্রয়োজনকে স্বীকার করেন। এই মানববাদী দল দেশ-কাল জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ সর্বমানবিক ঐশ্বর্যে ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী।
অবশ্য স্বাদেশিক ও স্বাধর্মিক রূপ-প্রতীক প্রীতির আড়ালে জ্ঞানগত অসামর্থ্যও আছে। ডালিয়া ডেইজি ডেফোডিল ক্যামেলিয়া রডেনডভ্রো বিদ্যাসাপেক্ষ। অধিগত বিদ্যা ও জ্ঞানের পরিসরেই মানুষের মন-মননের বিচরণ। আবার পরিচিত দেশী রূপ-প্রতীক সাধারণ পাঠকের সহজবোধ্য। কাজেই সেদিক দিয়ে তা অভিপ্রেত। কিন্তু সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তারকামীর পক্ষে দেশান্তরে রূপ প্রতীক সন্ধান আবশ্যিক। যারা স্বজাতির ও স্বধর্মীর ঐতিহ্যনিষ্ঠ, তারা ভুলে থাকেন যে ভবিষ্যতের জন্যে ঐতিহ্য সৃষ্টির দায়িত্ব তাঁদেরও রয়েছে এবং সে দায়িত্ব পালন করতে সম্মুখ দৃষ্টির প্রয়োজন। ফেলে-আসা পশ্চাতের দিকে তাকাতে হলে দেহ ফিরিয়ে পশ্চাৎকেই সম্মুখ করতে হয় এবং তাতে অগ্রগতি কেবল ব্যাহতই হয়। এমনি ঐতিহ্যনিষ্ঠ শিল্পী-সাহিত্যিকের দানে পাঠকের মন-আত্মার বিকাশ অসম্ভব, কেননা এতে লেখক-পাঠক কারো চিত্তের বদ্ধতা ও অন্ধতা ঘুচে না।
মানুষের প্রগতির পথে ঐতিহ্যের পাথেয় কি অপরিহার্য? ঐতিহ্য কি সবার থাকে? দিগ্বিজয়ী সিকান্দর-চেঙ্গিস- এটিলার কি ঐতিহ্য ছিল? হযরত ইব্রাহিম-মুসা-ঈসা- মুহম্মদের, সক্রেটিস এ্যারিস্টটল-কনফুশিয়াসের, কোপার্নিকাস-রুশো-গেলেলিওর, শেকসপীয়ার- গ্যটে-রবীন্দ্রনাথের কিংবা ডারুইন-মার্ক-ফ্রয়েডের কি ঐতিহ্য ছিল? এঁরা প্রত্যেকেই কি স্বস্ব ক্ষেত্রে দেশীয়, গোত্রীয় বা জাতীয় ঐতিহ্য পরিহার করে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেননি? বুনো নিগ্রোদের রাষ্ট্রিক ঐতিহ্য নেই বলে কি তাদের আত্মোন্নয়ন ও আত্মপ্রসার রুদ্ধ থাকবে? মানুষের জীবনে সত্যি সত্যি ঐতিহ্য প্রেরণার প্রয়োজন যদি থাকে তবে তা হবে মানবিক ঐতিহ্য–প্রয়াসে ও প্রযত্নে মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। এবং এ প্রত্যয় অঙ্গীকার করে এগুলোই হবে তার কর্তব্য।
তাছাড়া ধর্মসূত্রে, শাসনসূত্রে, জ্ঞান ও বিদ্যাসূত্রে মানুষ কি চিরকাল বিদেশী-বিজাতি ও বিভাষী-বিধর্মীর ঐতিহ্যকে নিজের করে নেয়নি? তাহলে স্বাদেশিক ও স্বাধর্মিক ঐতিহ্যে ঐকান্তিক নিষ্ঠা বদ্ধচিত্তের অন্ধতারই নামান্তর। সাহিত্য-শিল্প-দর্শন মানুষের একই বৃত্তি-প্রবৃত্তির এবং ব্যক্তি সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র সম্পর্কিত সমস্যা, সংকট-আনন্দ যন্ত্রণা ও ভাব-চিন্তার অভিব্যক্ত রূপ।
গদ্যে পদ্যে বাঙলা সৎসাহিত্যে বহিরাঙ্গিক উপাদান-উপকরণ দৈশিক ও কালিক। আর্থিক দৈন্য, সামাজিক পশ্চাৎমুখিতা, প্রশাসনিক ত্রুটি, নৈতিক শৈথিল্যে মানবিক দায়িত্বে অস্বীকৃতি ও কর্তব্যে অবহেলা, রাজনীতিক অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতির পটভূমিকায় মানুষের দয়া দ্বন্দ্ব, প্রীতি-অসূয়া ভয়-ভরসা, পীড়ন-পোষণ, মাৎসর্য-রিরংসা, আনন্দ-যন্ত্রণা-সম্পদ-সমস্যা, চাওয়া পাওয়া প্রভৃতির রূপায়ণ ঘটেছে। এই রস সর্বমানবিক জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে মানবিক সমস্যার সমাধান-প্রয়াস ও প্রতিবেশ- প্রভাবিত মানবিক বৃত্তি-প্রবৃত্তির স্বরূপ নিরূপণই তাই এ সাহিত্যের অন্তরঙ্গ রূপ।
অতএব ভাষা বা ভঙ্গি, কাহিনী বা বিষয়, গৌরব বা লজ্জা, ক্ষোভ বা উল্লাস, বিশ্বাস বা সংস্কার, আদর্শ বা উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য কিংবা সমস্যা হবে স্থানিক ও কালিক, কিন্তু প্রতিপাদ্য বিষয় থাকবে সর্বমানবিক। অর্থাৎ স্থানিক ও কালিক বিষয় হবে সাহিত্যের বহিরঙ্গ আর অন্তর্নিহিত রস হবে সর্বজনীন।
আমাদের পূর্ব বাঙলার সাহিত্যে আমরা পূর্ব বাঙলার মানুষ ও প্রকৃতিকেই প্রত্যাশা করি। এই মানুষ ও প্রকৃতি পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে না। অর্থাৎ সব মানুষে ও প্রকৃতিতে গূঢ় সাদৃশ্য থাকলেও বাহ্য স্বাতন্ত্র্য থাকে অলঙ্ঘ্য। এখানকার মানুষ তার বিশ্বাসে সংস্কারে, মনে মননে ও আদর্শে উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র। তার ভূত-প্রেত-দেও তার, হুর- পরী-জীন, তার যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব, তার আকাশ-জল-মাটি, তার তুকতাক-দারু-টোনা, তার-ঝাড়ফুঁক-মানত, তার-তাবিজ-কবজ, মাদুলি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে।