অতীতকে অতীতের নিরিখে যাচাই করা ও প্রত্যক্ষ করা সদ্বুদ্ধিজাত সদুপায়, সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীতকে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পুঁজি করার মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিংবা কল্যাণ নেই–আছে অন্ধ আবেগ যা আপাতদৃষ্টে কেজো বটে, কিন্তু পরিণামে রক্ষণশীলতা ও সংস্কারাচ্ছন্নতার জনক। কেননা, পুরাতনে আসক্তিহীনতা এবং পরিহার-সামর্থ্যই অগ্রগতির স্বাভাবিক সদুপায়। জাতীয় জীবনের জাগরণ মুহূর্তের আবেগ, উৎসাহ ও কর্মোদ্যমকে পুরাতনের প্রেরণা বলে ভুল করার ফলেই পুরাতনকে জীবন-প্রয়াসের মহিমান্বিত উৎস বলে প্রতীতি জন্মায়। পুরাতনের অঙ্গীকারে নতুনের জন্ম-প্রত্যাশা স্ববিরোধী অদ্ভুত চিন্তার প্রসূন। পুরাতনে আস্থাহীনতাই বরং ভবিষ্যতে নতুন প্রত্যয় লাভের সহজ উপায়।
ঐতিহ্য প্রেরণার উৎস বলে চালু কথাটির তাৎপর্য কিন্তু ভিন্ন। যে ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ অতীতে ব্যক্তিক কিংবা জাতীয় জীবনে কল্যাণ ও সাফল্য এনেছে, তা-ই ঐতিহ্য। দেশকালের প্রেক্ষিতে যা সেদিন মঙ্গলকর ও ফলপ্রসূ ছিল, পরিবর্তিত পরিবেশে তা অহিতকর এবং নিষ্ফলও হতে পারে। কাজেই ঐতিহ্যের অবলম্বন মানে তার অনুকরণ নয়, তার নব রূপায়ণ নয়, তার আশ্রয় গ্রহণ নয়, নয় তার প্রশ্রয় কামনাও, বরং প্রয়োজন ও পরিবেষ্টনীর দিকে দৃষ্টি রেখে হিতকর ও ফলপ্রসূ উপায় গ্রহণ ও রীতি-পদ্ধতির প্রবর্তন। কখন, কী অবস্থায়, কোন্ সঙ্কটে কিংবা সৌভাগ্যে কেমন করে কী করা হয়েছিল তা কিভাবে ব্যক্তিক, পারিবারিক অথবা জাতীয় জীবনকে রক্ষা ও ঋদ্ধ করেছিল, তা স্মরণ করার নামই ঐতিহ্য-চেতনা। অতএব ঐতিহ্যের অনুরণন-অনুসরণ বাঞ্ছনীয় হতে পারে, কিন্তু অনুকরণ কিংবা রূপায়ণ কখনো কাম্য নয়। তাছাড়া অতীতে যারা আমাদের জন্যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তারাও একে নিত্যকালের জন্যে ধরে রাখেননি। তাঁরা নতুন নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন আমাদের জন্যে তাঁদের প্রাত্যাহিক ভাব-চিন্তা-কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে। একবারের সৌভাগ্যের ও সাফল্যের উপায়কে তারাও চিরকালের উপায় বলে গ্রহণ করেননি। তাই ঐতিহ্যমাত্রই অতীতের। সেই পরিত্যক্ত রীতি-পদ্ধতি ও কর্মচিন্তা লোকস্মৃতির প্রশ্রয়ে কিংবদন্তির আশ্রয়ে বেঁচে থাকে কালান্তরে। স্রষ্টারই পরিত্যক্ত সামগ্রীকে তার উত্তর পুরুষেরা মহামূল্যজ্ঞানে যদি পাথেয়রূপে জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করে, তাহলে তাদের চলা চক্রের আবর্তন বই কিছুই নয়। ব্যবসায় মূলধন যেমন উপার্জনের ভিত্তি, ঐতিহ্যের পুঁজিও তেমনি অগ্রগতির সহায়। মূলধনে হাত পড়লে ব্যবসা টেকে না, তেমনি ঐতিহ্য আঁকড়ে বসে থাকলেও গতি হয় রুদ্ধ।
আবার উদ্যমহীন নিষ্কর্মার ঐতিহ্যপ্রীতি ও ঐতিহ্যর্গব আরো মারাত্মক। ধনী-সন্তানের সম্পদ চেতনা যেমন, ঐতিহ্যগবীর গৌরব-স্মৃতিও তেমনি তৃপ্তমন্যতা জাগায়, যা প্রয়াসহীন জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। তৃপ্তমন্য গৌরব-গী পরিবার কিংবা জাতির পতন অনিবার্য। অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস–দু-ই এই আপ্তবাক্যের যাথার্থ্য সমর্থন করে।
নিজের ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে মানুষ যখন তার চারপাশে কোনো আধার বা অবলম্বন খুঁজে পায় না, তখন সে অতীতের দিকে ফিরে তাকায়; অতীতের ঘটনা, চিন্তা বা কাহিনী সে উপস্থাপিত করে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এবং উপমা রূপক ও উৎপ্রেক্ষারূপে অথবা কাহিনীরূপে ব্যবহৃত হয়ে তা ভাবকল্প ও চিত্রকল্পের অবয়বে তখন আত্মপ্রকাশ করে। অতীতকে এভাবে বর্তমান করে তোলাতে দোষ নেই। কিন্তু বর্তমানকে স্বকালে, স্বস্থানে ও স্বরূপে খুঁজতে না-জানার অসামর্থ্যের কিংবা বর্তমানকে দিয়ে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের অক্ষমতার স্বাক্ষর থাকে। কাজেই ঐতিহ্য-নির্ভরতা বর্তমান অবস্থার পরোক্ষ প্রকাশের বাহন মাত্র–প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তির উপায় নয়। অতএব সাহিত্যশাস্ত্রবিদ যখন বলেন :
An Artist of the first rank accepts tradition and enriches it, an artist of the lower rank accepts tradition and repeats it, and artist of the lowest rank rejects tradition and strives for originality. (Sampson)
তখন কথাগুলো শুনতে চমকপ্রদ বটে; কিন্তু সত্যের বিপরীত। যেমন ঔপন্যাসিক তাঁর চারদিকে কোনো উপকরণ যখন খুঁজে পান না, তখন তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে আনন্দিত হন।
অপরের সৌভাগ্যে ও পীড়নে যারা ঈর্ষ ও ক্ষুব্ধ অথচ অসহায় ও অক্ষম, তাদের চিত্তে জন্ম নেয় Revivalism-এর স্বপ্ন। তাদের বর্তমান অযোগ্যতা তাদেরকে অতীত গৌরবগবী করে তোলে। তাতে তারা বর্তমানের আত্মগ্লানি ও আর্তনাদ গৌরবময় ঐতিহ্যের আস্ফালনে ঢাকা দিতে চায়। বর্তমান দীনতার দুঃখ-লাঞ্ছনা ভুলবার উপায় হিসেবেই ঐতিহ্যের আশ্রয়ে তারা প্রবোধ ও প্রশান্তি খোঁজে। উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তির যেমন পিতৃসম্পদেই ভরসা ও নির্ভরতা, Revivalism এ আসক্তিও অনেকটা সেইরূপ। অতএব Revivalism অক্ষমের সান্ত্বনা। পুরাতনকে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহের মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যাশাহীনতা। বর্তমানে কিছু করবার নেই, ভবিষ্যতে কিছু পাবার কিংবা হবার নেই–এমনি প্রতায়হীনতাই মানুষকে করে অতীতমুখী। তাদের চোখে পৃথিবী যেন সহসা এক জায়গায় আকস্মিকভাবে স্তব্ধ ও স্থবির হয়ে যায়। তার গতিপ্রবাহ যেন চিরকালের জন্যে থেমে গেল, যেমন এগুবার আর উপায়ও নেই, প্রয়োজনও নেই। কাজেই বর্তমানে না কুলায় তো অতীতের সঞ্চিত সম্পদ কাজে লাগাও, দুর্দিনের সম্বল কর। কেননা অতীতের সে-পরিবেশে আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন স্বগৌরবে, স্বশক্তিতে ও স্বমহিমায় বেঁচেছিলেন–কাজেই অতীতের সেই কোটরই অভয়-শরণ –তখন এমনি অপবুদ্ধি মনে সহজেই জাগে। Revivalism-এ মনের বিকাশবিস্তার হওয়া তাই অসম্ভব।