তন রাধা মন কানু শাহনুরে বলে।
অথবা,
সৈয়দ শাহনুরে কয় ভব কূলে আসি।
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী।
অথবা, উসমানের কথায় :
রাধা-কানু এক ঘরে কেহ নহে ভিন।
রাধার নামে বাদাম দিয়া চালায় রাত্রিদিন।
কানুরাধা এক ঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।
সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :
আনন্দমোহন মওলা খেলা ধামালী
আপে মন আপে তন আপে মন হরি।
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারি
সৈয়দ মর্তুজা কহে, সখি, মওলা গোপতের চিন
পুরান পিরীতি খানি ভাবিলে নবীন।
এর সঙ্গে স্মর্তব্য :
রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যান্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি।
বিকৃত বৈষ্ণব সাধক বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার রহস্যভেদে প্রয়াসী।
সাহিত্যে দেশ কাল ও জাতিগত রূপ
মানুষ তার স্বদেশে স্বকালের জাগতিক আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যার মধ্যেই জীবন নির্বাহ করে। অতএব দেশগত ও কালগত সম্পদে ও প্রভাবে মানুষের দেহ-মন-আত্মা গড়ে উঠে। অর্থাৎ মানুষ তার দৈশিক জলবায়ু প্রকৃতি-নিসর্গ এবং ভাষা ও জীবিকা-পদ্ধতি এবং কালিক ধর্মবোধ বিশ্বাস, সংস্কার, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, আচারিক নিয়ম, সামাজিক বিধান ও রাষ্ট্রিক শাসনের মধ্যেই লালিত হয়। কাজেই মানুষের জীবনচেতনার বারোআনাই দেশ-কালের দান, বাকি চার আনা অনুশীলন লব্ধ। আবার বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান ও শিক্ষা ভেদে মানুষের চেতনায়ও বিকাশ ভেদ ও বৈচিত্র্য থাকে। এজন্যেই মানুষের অভিব্যক্ত আচরণে মগ্ন চৈতন্যের প্রভাব যত বেশি, পরিস্রত-চেতনার সাক্ষ্য তত নেই। ফলে বোধ-বুদ্ধি ও জ্ঞান-সংস্কৃতি সম্পন্ন অগ্রসর মানুষের সংখ্যা কম।
এই স্বল্পসংখ্যক অগ্রসর মানুষই তাদের অনুশীলন লব্ধ ভাব-চিন্তা-জ্ঞান প্রত্যয়ে ও কর্মে, আচরণে ও আবিষ্কারে, শিল্পে ও সাহিত্যে এবং দর্শনে ও ইতিহাসে প্রকাশ করেন। সামান্য অর্থে জীবনচেতনাই সংস্কৃতি। এ তাৎপর্যে প্রত্যেক সভ্য ও অসভ্য ব্যক্তির সংস্কৃতি রয়েছে কিন্তু তা সর্বমানবে সুলভ বলেই আমরা তাকে সংস্কৃতি বলে স্বীকার করিনে। অতএব বিশেষ পরিশীলিত চেতনাই সংস্কৃতি এবং সে-কারণে সংস্কৃতি সব সময়েই ব্যক্তিক। তা কখনো দেশগত কিংবা সমাজাশিত হতে পারে না। সংস্কৃতিকে যদি রুচি ও কর্মে বিভক্ত করি, তাহলে যা দেখতে শুনতে বলতে-করতে-শুঁকতে চাখতে-ধরতে কুৎসিত তা এড়িয়ে চলা এবং যা সুন্দর–শোভন ও কল্যাণকর- প্রত্যয়ে ও কর্মে, আচারে ও আচরণে, বরণে ও বর্জনে, সৃজনে ও আবিষ্কারে তার অনবরত চর্চাই সংস্কৃতি। ব্যক্তিক সংস্কৃতি অনুকৃত হয়ে দৈশিক, সামাজিক কিংবা জাতিক-রাষ্ট্রিক সংস্কৃতি রূপে পরিচিত হয়। আসলে ব্যক্তিক চেতনাসঞ্জাত সংস্কৃতি অনুকারীদের পক্ষে আচার মাত্র। এবং তা-ই দেশীয়-জাতীয় কিংবা গোত্রীয় সংস্কৃতি নামে অভিহিত হয়।
ব্যক্তিক সংস্কৃতিতে যে সৌন্দর্য-বুদ্ধি, কল্যাণ-চিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, গ্রহণপ্রবণতা, সৌন্দর্য- অন্বেষা থাকে; দৈশিক, সামাজিক কিংবা জাতিক সংস্কৃতিতে তা থাকে না বলেই তা প্রাণহীন লোকাঁচার মাত্র। আর তখন সে-সংস্কৃতি প্রাণের প্রেরণা নয়-সুজনের সুরুচি সুকর্ম ও সৌজন্য নয়, আচারের বেড়ি বা সংস্কারের শৃঙ্খল মাত্র। যেমন ধূতি-চাদর কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি বাঙালির সংস্কারগত আচার মাত্র। কিন্তু এ পোশাক উদ্ভাবকের পক্ষে ছিল সংস্কৃতিবানতা।
সাধারণত মানুষের সংস্কৃতি প্রকাশ পায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য চেতনায়; তার সৌন্দর্য, সুরুচি ও সৌজন্য বোধে; তার ন্যায়-অন্যায় বোধজাত আইন-কানুনে; তার নৈতিক-সামাজিক আর্দশানুগত্যে; তার বরণ-বর্জন ক্ষমতায়, ঈর্ষা-দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-ঘৃণা-লোভে-ক্ষোভ প্রভৃতির ক্ষেত্রে তার সংযম সাধনায়; পরের প্রতি তার প্রীতি ও শুভেচ্ছার অনুশীলনে ও তার মানবকল্যাণ কামনায়। কাজেই সংস্কৃতি পরিসুতি ও পরিশীলন সাপেক্ষ।
শিল্প-সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতি মানস-সংস্কৃতির প্রসূন। যার সংস্কৃতি নেই, তার সৃজনশীলতা নেই। ব্যক্তিভেদে সংস্কৃতির মাত্রাভেদ আছে। কাজেই শিল্পে-সাহিত্যে-দর্শনেও গুণভেদে উৎকর্ষের স্তরভেদ রয়েছে। সংস্কৃতির প্রকাশ সাহিত্যে সুলভ। আমাদের পূর্ববাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের পরিমাপও তাই আমাদের সাহিত্য দিয়েই সহজে করা সম্ভব।
আগেই বলতে চেয়েছি, দেশগত ও কালগত জীবন মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্মে প্রতিফলিত হয়। সাহিত্য সেই জীবনের প্রতিবিম্বিত রূপ। শিক্ষা ভেদে, মন ভেদে, আর্থিক-সামাজিক অবস্থানভেদে মানুষের জীবনচেতনা বিভিন্ন হয়। কাজেই সাহিত্যও হয় বিভিন্ন স্তরের, আদর্শের ও লক্ষ্যের। জ্ঞান রুচি-আদর্শ ও চিত্তের প্রসারভেদে ভাষা, ভঙ্গি, অলঙ্কার এবং অনুভূতি ও দৃষ্টি হয় বিভিন্ন। কাজেই সাহিত্যের বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে দৈশিক ও কালিক স্বাক্ষর থাকেই।
সৎসাহিত্যের রস সর্বমানবিক হওয়া সত্ত্বেও দেশ-কালের প্রভাব থাকে বলেই সাহিত্য কখনো নির্বণ, নির্বিশেষ ও নির্লক্ষ্য হয় না। বক্তব্যের অবলম্বন হয় দেশজ-কালজ আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, গৌরব কিম্বা লজ্জা, সম্পদ কিংবা সমস্যা, আশা কিংবা নৈরাশ্য। আমাদের বাঙলা সাহিত্যেও তা সুপ্রকট।