সৈয়দ সুলতান প্রভৃতি মুসলিম কবিরা শেষোক্ত কারণেই রাধা-কৃষ্ণ রূপকে পদ রচনা করেছেন। সূফী হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের মনে রাধা-কৃষ্ণের রাস, মৈথুন প্রভৃতির কল্পনা প্রশ্রয় পাওয়ার কথা নয়। তাই তারা রূপ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন বিরহ প্রভৃতিকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে গ্রহণ করতে পারলেও বস্ত্র হরণ, দান, সম্ভোগ, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতির সঙ্গে তাদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মিল খুঁজে পাননি। সেজন্যে মুসলমানের লেখায় ওসব শ্রেণীর পদ সাধারণত পাওয়া যায় না। তাদের রচনায় অনুরাগ ও বিরহবোধ এবং জীবন-জিজ্ঞাসাই বিশেষরূপে প্রকট।
সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–এটিই রূপ; সৃষ্টিবৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক বোধ জন্মে–এটিই অনুরাগ এবং তাঁর প্রতি কর্তব্যবুদ্ধি জাগে–এটিই বংশী আর সাধনার আদি স্তরে পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে–তারই প্রতীক নৌকা। এর পরে ভাবপ্রবণ মনে আত্মসমর্পণব্যঞ্জক সাধনার আকাক্ষা উপ্ত হয়–এটিই অভিসার। এর পরে সাধনায় এগিয়ে গেলে অধ্যাত্ম স্বস্তি আসে–তা-ই মিলন। মিলনে আত্মসমর্পণের আকুলতা প্রশমিত হয়–তা-ই ফানাফিল্লাহ। এরও পরে চরম আকাক্ষা–একাত্ম হওয়ার বাঞ্ছ, যার নাম বাকাবিল্লাহ-এই বিরহ। মৃত্যুর আগে সাধারণের পরম মিলন নেই, সেজন্যেই বাকাবিল্লাহ সূচক পদের অভাব। কেউ কেউ সে দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন। তারাই বাকাবিল্লাহ হন–আর বলেন আনল হক, বা। সোহম–যেমন মনসুর, বায়যিদ ও আদহাম বলেছেন। এজন্যেই মুসলিম রচিত পদ রাগানুগ নয়। শশিভূষণ দাশগুপ্তও তাই বলেন :
এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যাইত পারে যে, বাঙ্গালার মুসলমান কবিগণ রাধা-কৃষ্ণকে লইয়া যে কবিতা রচনা করিয়াছেন তাহা কোনো বিধিবদ্ধ বৈষ্ণবধর্মের আওতায় রচিত নহে। … বৈষ্ণবমতে রাধাকৃষ্ণের যত লীলা তাহার ভিতর মানুষের কোনো স্থান নেই। … শ্রীকৃষ্ণের সহিত মিলন বাসনাও বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত-বিরুদ্ধ। … কিন্তু অন্যরূপ পরিণতির সম্ভাবনা দেখা দিল মুসলমান কবিগণের ভিতরে, কারণ তাহারা চৈতন্য প্রবর্তিত একটি সাধারণ প্রেমধর্মের প্রভাব সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করিলেন; একটা সাহিত্যিক বিষয়বস্তু এবং প্রকাশভঙ্গিও উত্তরাধিকার সূত্রেই পাইলেন, কিন্তু পাইলেন না রাধাকৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধে কোনো স্থিরবদ্ধ ভাবদৃষ্টি। সুতরাং বাঙ্গালার জনসমাজে যে সাধারণ ভক্তিধর্ম ও যোগধর্ম প্রচলিত ছিল, এই সকল কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সেই সকলের সঙ্গেই যুক্ত করিয়া লইলেন। বাঙ্গালা দেশের প্রেমপন্থী মুসলমান সাধকগণ অল্পবিস্তর সকলেই সুফীপন্থী সূফীমতে প্রেমই হইল। ভগবানের পরম স্বরূপ প্রেমের দ্বারাই আবার এই জগৎ সৃষ্টি। নিজের অনন্ত প্রেম আস্বাদনের জন্যই এক পরম স্বরূপের, বহুরূপে লীলা, ইহাই হইল সৃষ্টির তাৎপর্য। জীব হইল এই এক-এর সৃষ্টিলীলার প্রধান শরিক-লীলা দাসর। .. সূফী প্রেমধর্ম এবং বাঙ্গালার প্রেমধর্ম জনগণের মধ্যে যে একটি জনপ্রিয় সহজ সমন্বয় লাভ করিয়াছে, বাঙ্গালাদেশের মুসলমান কবিগণ সেই সমন্বয়জাত প্রেমধর্মের আদর্শের সহিত রাধাকৃষ্ণকে অনেক স্থলে মিলাইয়া লইয়াছেন। ফলে রাধার যে পূর্বরাগ অনুরাগ বিরহের আর্তি, তাহা কবিগণের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পরম দয়িতের জন্য নিখিল প্রেমসাধকগণের পূর্বরাগ বিরহের আর্তিতেই পরিণতি লাভ করিয়াছে এবং সেই আর্তির ক্ষেত্রে কবি নিজেকে শুধু দর্শক বা আস্বাদক রূপে খানিকটা দূরে সরাইয়া লন নাই, নিখিল আর্তির সহিত নিজের চিত্তের আর্তিকেও বিলাইয়া দিয়াছেন। ইহারই ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব কবিগণের ভাবদৃষ্টি হইতে বঙ্গীয় মুসলমান কবিগণের ভাবদৃষ্টি অনেক স্থানে পৃথক হইয়া পড়িয়াছে। আমরা মুসলমান কবিগণের রচিত রাধা-কৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধীয় পদগুলির ভণিতা লক্ষ্য করিলেই এই কবিগণের মূল ভাবদৃষ্টির ও ইঙ্গিত পাইব।
উত্তরভারতীয় সাধক কবিগণও রাম বা রাধাকৃষ্ণকে এমনি ভাবদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন এবং নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করেছেন। দাদু, দরিয়া, রজব, শেখ কাইম, এয়ারী, মইজুদ্দীন, আফসোস প্রমুখ কবির পদাবলী এ সাক্ষ্যই বহন করে।
বাঙলাদেশে রাধাকৃষ্ণ জীবাত্মা পরমাত্মার প্রতীক যেমন হয়েছেন, তেমনি দেহ ও আত্মা–ভক্ত ও ভগবানের রূপক হিসেবেও তাদের পাই। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে বাউল সাধনায় দেহতাত্ত্বিক তাৎপর্যেও রাধাকৃষ্ণ চিহ্নিত। অবশ্য দেহতত্ত্বের প্রতীকী প্রকাশে রাধা-কৃষ্ণ তন-মনের প্রতিনিধিত্বে সীমিত থাকেননি, তন-মনের অস্থির ও বিভ্রান্তিকর রূপকল্প হয়েছেন। একে তো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর, তাদের রক্তের সংস্কারে ভারতিক প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা সূফীমতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে। সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভারতিক ভক্তিবাদ তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের সঙ্গত কারণ খুঁজে পাই :
সৈয়দ শাহনুরে কয় রাধাকানু চিন হয়।
রাধাকান্ত আপনার তনে রে।
আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ