অপর একজন কবিও বলেন :
কহে হীন দানিশ কাজী ভাবি চাহ সার
রাগযন্ত্র নাদ সব ঘটে আপনার।
অষ্টাঙ্গ তন্ন মধ্যে আছএ যে মিলি।
তনান্তরে মন-বেশি করে নানা কেলি।
মোকামে মোকামে তার আছে যে স্থিতি
ছয় ঋত তার সঙ্গে চলে প্রতিনিত।…
রাগঋত অন্ত যদি পারে চিনিবার
জীবন মরণ ভেদ পারে কহিবার।
কিবা রঙ্গ কিবা রাগ কিবা তার রূপ
ধ্যানেত বসিয়া দেখ ঘটে সর্বরূপ।
বাঙালি মুসলিম সমাজে সঙ্গীতচর্চা যে সূফী প্রভাবেরই ফল, আমাদের সে অনুমান উক্ত চরণ কয়টির দ্বারা প্রমাণসিদ্ধ হল। কবি সৈয়দ সুলতান, আলাউল প্রভৃতিও সূফী সাধক ও পীর। তাদের সঙ্গীতপ্রীতি সাধনার অনুগত। আর তত্ত্ব-সঙ্গীত রচনার প্রেরণাও তাঁরা সাধন-সূত্রেই পেয়েছেন। আগেই বলেছি, বাঙালি মুসলিম মরমীয়ারা যে-সাধন পন্থা গ্রহণ করেছেন, তা মূলত ইসলামী নয়। ভারতিক সূফীমতবাদও একান্তভাবে আরব-ইরানি নয়। এর অবয়বে যেমন ভারতিক প্রভাব পড়েছে, বাঙালি মরমীয়াদের দর্শনে, ধর্মে ও আচারে প্রচুর দেশজ তথা ভারতিক উপাদান রয়েছে। কাজেই এদেশে হিন্দু-মুসলমান চিরকাল হাতে হাত মিলিয়ে ও মনে মন মিশিয়ে অধ্যাত্ম সাধনা করেছে। এভাবেই বাঙালি দেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনায় মরমীয়াদের উপমতগুলো সৃষ্টি হয়েছে।
বলেছি, মুসলিম অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তাঁরা সবাই সূফী ছিলেন। এই মরমীয়াদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ সাধারণের পক্ষে ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে ধর্মাচরণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। ফলে মুসলমানেরা তাদের চারপাশেই অবলম্বন খুঁজেছে। এভাবেই তাদের তত্ত্ব-দর্শনে পীরপূজা ও দেহচর্যা মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাদের তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে ভারতিক রূপকল্প।৬৯ আরাধ্যের প্রতীক হলেন রাম ও রাধাকৃষ্ণ, এমনকি কালীও।
.
০৫.
মরমীয়াদের মতে, সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার আনন্দ সহচর। কাজেই মানুষের সঙ্গে আল্লাহর বান্দা-মনিব সম্পর্ক হতে পারে না; হতে পারে না পিতা-পুত্রের কিংবা ভক্ত-ভগবানের সম্বন্ধ। মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্বের, প্রণয়ের। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই নামাজ-রোজার বা এই প্রকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ত সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহবোধে উপলব্ধি এবং মিলনে সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এই প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। স্বরূপত খণ্ডের অখণ্ডে বিলীন হওয়ার আকুলতার নামই প্রেম।
গরজ খণ্ডের তথা জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক, তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে। যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর সমষ্টি মাত্র। বারিবিন্দুর উপরই তার অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন, পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে : এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনল হক কিংবা সোহম। এ অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ অথবা বাকাবিল্লাহ আর বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। এ দুটোতে সূক্ষ্ম দার্শনিক তাৎপর্যের প্রভেদ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায় মূলত একই।
কুন ফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। আর একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী; কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াস। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সূফী–বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর ভাষায় :
দানা ছুঁ অন্দর জমিন পেনহা শওয়াদ
বাদ আজো সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।
জীবাত্মা তখন বাঁশীর মতো বলে: বসোনো আজনায়ে ফুঁ হেকায়েত নি কুনদ…।
জ্ঞানদাসও বলেন : অন্তরে অন্তর কাঁদে কিবা করে প্রাণ অথবা পরাণ পিরীতি লাগি স্থির নাহি বাধে।
রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন :
বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা
এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
এজন্যে সূফীগানে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলনপিপাসু বিরহী আত্মার করুণ কান্না শুনতে পাই। সূফীগজল ও বৈষ্ণবপদ মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-এর সুর ও বাণী বহন করেছে। তার বেদনার অন্ত নেই। কেননা, সর্বক্ষণ চিত্তকাড়া কালার বাঁশি লাগিছে অন্তরে, সে কারণেই চিরকাল কাদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।
এই প্রেমধর্মের আর একটি দিক হচ্ছে আত্মতত্ত্ব। কেননা, আত্মা এই প্রেমের এক পক্ষ তথা প্রেমিক। আর আত্মা পরমাত্মার অংশ তো বটেই। তাই সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, হাদিস বলে অভিহিত ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু কিংবা উপনিষদের তং বেদ্য পুরুষৎ বেদমা বো মৃত্যু পরিব্যথাঃ-এই আত্মতত্ত্বের ভিত্তি ও লক্ষ্য দুই-ই। মুসলিম মরমীয়া কবিদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের কয়েকটি কারণ অনুমান করেছেন অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য। ৭০ তার মধ্যে তিনটে প্রধান- ক, দেশজ মুসলমান পূর্বসংস্কার বশে চৈতন্যের প্রেম-ধর্ম প্রচারকালে রাধাকৃষ্ণ লীলারসে মুগ্ধ হয়ে নিজেরাও পদ রচনা করেছেন। খ. রেওয়াজের প্রভাবে রাধাকৃষ্ণের রূপকে পদ রচিত হয়েছে বটে, তবে কৃষ্ণ অনেক মুসলমান কবির কাছে অপৌরুষেয়। এবং কানু ছাড়া গীত নেই যুগের নৈর্ব্যক্তিক নাগর কানাইরূপে লৌকিক প্রেমের নায়ক হয়েছেন। গ. আর সুফী মতের মুসলমানরা ভাব-সাদৃশ্য বশে জীবাত্মা-পরামত্মসূচক জনপ্রিয় দেশী রূপক হিসেবে রাধাকৃষ্ণের শরণ নিয়েছেন।