য়া বুনাইয়া লা তকিজ-ই সামা
ফা ইন্নাহা লাহ্ওয়া ওয়ালা ইব।
(বৎস, সঙ্গীত পরিহার করো না, বহু মহাপুরুষ তা চর্চা করেছেন
সূফীদের মতে সঙ্গীত অধ্যাত্মসাধনায় সিদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ইবনুল ফরিদ বলেন : সঙ্গীতের মূর্ঘনার মধ্যে আমি আমার দয়িতকে (আল্লাহকে) সমগ্র সত্তা দিয়ে দেখি।
আবুল কাসিম অল বঘবী (Baghwi) বলেন : সঙ্গীত আত্মার (spirit) খাদ্য। আত্মা যখন খাদ্য পায়, তখন দেহের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ হয়।
জালালুদ্দিন রুমীও বলেন, আগার আজ বুর্জি মানা-ই বুয়াদ সাইর-ই-উ ফিরিশতাহ্ ফিরু মানাদ আজ তায়র-ই-উ।
(If the musician soars up to pinnacle of ecstasy, the angel cannot follow in pursuit of him,)
চিশতিয়া সোহরওয়ার্দিয়া, কলন্দরিয়া, মারিয়া, কাদিরিয়া এবং মখদুমিয়া সূফীদের দান বাঙলাদেশে ইসলাম বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ। আশরাফ জাহাগীর তার একটি চিঠিতে সগর্বে লিখেছেন :
In the blessed land of Bangal, there is hardly a village or town where a muslim Sufi is not to be found and the innumerable graves of the muslim mystics which dot the country are a silent testimony to their self-denying devotion to their ideal.
জালালউদ্দিন তাবরেজী সম্বন্ধে Siyar-ul-Arifin (p ১৭১) গ্রন্থে আছে?
Shaikhul Mashaikh Jalaluddin Tabrezi went to Bengal. All the people of that (place) turned towards him and became his disciples. The Shaikh established a khanqah there and started a free Kitchen…etc.
চিশতি সূফীদের মধ্যে সিরাজুদ্দিন উসমান ওফেঁ আখি সিরাজ তাঁর সাগরেদ আলাউল হক, আলাউল-পুত্র নূর-কুতুব-ই-আলম, তাঁর শিষ্য শেখ হেসামুদ্দিন মানিকপুরী (কারা মানিকপুরের) বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠাবান ছিলেন। নূর-কুতুব-ই-আলমের ওয়াহাদাৎ-উল ওজুদ বিষয়ক পত্রের আলোকে চৈতন্যদেব প্রবতিত নব-বৈষ্ণব ধর্মের বিশ্লেষণ করলে এতে সূফী প্রভাবের আভাস পাওয়া যাবে।
শরীয়তী ইসলাম আর পাক-ভারতে সূফী দরবেশ প্রচারিত মুসলমান ধর্ম এক নয়। কাজেই সূফী-দীক্ষিত মুসলমানেরা পাক-ভারতে অবাধে সঙ্গীতচর্চার সুযোগ পায়। বিশেষ করে চিশতিয়া খান্দানে তো সঙ্গীতের মাধ্যমেই সাধন-ভজন শুরু হয়। পরে কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রায় সব মরমীয়া সম্প্রদায়েই সামা, হাল্কা ও দারা সাধনার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। সিন্ধুর লতীফ শাহ, পাঞ্জাবের বুলে শাহ, আজমীরের খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, দিল্লীর নিযামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর খুসরু এবং সুফী শেখ বাহাউদ্দিন, শের মোহাম্মদ ও মিয়া দলু, সাচল, বেদিল, রোহল, কুতব, য়্যারী, দরিয়া থেকে বাঙলার লালনশাহ ও আহমদুল্লাহ শাহ প্রভৃতি সবাই সঙ্গীতকে সাধনার উপায় রূপে গ্রহণ করেছেন। তাদের দরগায় আজো সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। কাজেই পাক-ভারতে মুসলমানদের সঙ্গীতচর্চা কলা-বিলাস মাত্র নয়, জীবনচর্যার তথা ধর্মাচরণের বাহন। এভাবে সঙ্গীত সমাজে নতুন মহিমায় ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। কেবল তা-ই নয়, কবীর, দাদু, রজব প্রমুখ দেশী মরমীয়ারাও সঙ্গীতকেই প্রচারের ও ভজনের বাহন করেছেন। আদি সূফী দরবেশদের মধ্যে কেবল খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, কিংবা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া কোরায়শী মুলতানীই যে সঙ্গীতবিদ ও সঙ্গীত সাধক ছিলেন, তা নয়, আরো অনেক অখ্যাত দরবেশ ও তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্য সঙ্গীতানুশীলন জনপ্রিয় করে তোলেন। হযরত বাহাউদ্দিন জাকারিয়া রাগ-রাগিণীরও স্রষ্টা।
কবীর যেমন সূফী ও ভারতিক মরমীয়া ধারার সমন্বয় সাধক ৬৬; তেমনি আমীর খুসরুই মুসলিম (আরব্য-পারসিক তুর্কী) ও ভারতিক সঙ্গীতের মিশ্ৰধারার আদি প্রবর্তক। ৬৭ এখন থেকেই শুরু হল পাক-ভারতে সঙ্গীতের সোনার যুগ।
আগেই বলেছি, ইসলামের উদ্ভবের মাত্র কয়েক বছর পরেই উম্মাইয়াদের আমলে মুসলমানদের মধ্যে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। অবশ্য ইসলামেও স্বর-মাধুর্যে মর্যাদা আরোপিত হয়েছে। নামাজে শিরিন-সুরে কেরাত পড়ার সামর্থ্য ইমামের অন্যতম যোগ্যতা বলে স্বীকৃত। কিন্তু তবু গোড়া শরীয়তী কোনোকালেই সঙ্গীতকে সুনজরে দেখেনি। তা সত্ত্বেও এর সর্বগ্রাসী মায়াবী প্রভাব থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। তাই গোঁড়া মুসলিম সুলতান সিকান্দার লোদী কিংবা নিষ্ঠাবান গোড়া শরীয়তপন্থী ম্রাট আওরঙজীবও প্রথম জীবনে সঙ্গীতবিমুখ হতে পারেননি। পরে ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে শাফী মজাহাবী হয়ে আওরঙজীব সঙ্গীতবিরোধী হলেন।
.
০৪.
বাঙালি মুসলমানেরাও যে সঙ্গীতকে অপার্থিব উল্কণ্ঠার তথা অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার নিবৃত্তির ও সাধনার বাহন করেছিলেন, তা চিশতিয়া, কাদিরিয়া, কলন্দরিয়া প্রভাবের প্রমাণ ছাড়াও, আঠারো শতকের কবি আলি রজাব জবানীতে পাচ্ছি :
আলি হোন্তে সে সকল সন্ন্যাসী ফকিরে
শিখিল সকল যন্ত্র রহিল সংসারে।
ভাবের বিরহ সব শান্ত হৈতে মন
রাগতাল কৈল প্রভু সংসারে সৃজন।
সর্বদুঃখ দূর হয় গীত যন্ত্র রাএ।
গীত যন্ত্র শুনি মহামুনি ভ্রম যাএ।
গীত যন্ত্র মহামন্ত্র বৈরাগীর কাম।
রাগযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভুর নিজ নাম।
জীববন্ত যথ আছে ভুবন ভিতর
সর্বঘটে যন্ত্র বাজে গীতের সুস্বর।
ঘটে গুপ্ত যন্ত্র গীত যোগিগণে বুঝে।
তেকারণে সর্বজীবে সে সবারে পূজে।
গীতযন্ত্র সুস্বর বাজায় যে সকলে
মহারসে ভুলি প্রভু থাকে তা মেলে।
শুদ্ধভাবে ডুবি নৃত্য করে যেই জনে
গীতরসে মজি প্রভু থাকে তার সনে।