দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মৌলানা উপরোক্ত পরোক্ষ উক্তির ও তথ্যের প্রমাণে সঙ্গীত যায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম জাফর সাদিক, শেখ আবু এজিদ বিস্তামী, শেখ ইবনুল আরাবী, নুর কুতব-ই-আলম পাণ্ডুবী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, শাহ রফিউদ্দিন, ইব্রাহিম সাদ জহিরী, শেখ আবু তালিব মক্কী, আবদুল হক দেহলবী, মৌলনা মুহম্মদ শাহ্ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ প্রাচীন ও নবীন অনেক সাধক ও আল্লামা সঙ্গীতকে বৈধ বলেছেন।
নক্শবন্দিয়া ছাড়া আর সব মতের সূফীরাই সঙ্গীতকে সাধনার মাধ্যম করে নিয়েছেন।
বলেছি, শেখ আহমদ মুজাদ্দাদী নকশবন্দী ছাড়া অন্যান্য প্রধান সূফীদের সবাই সাধনায় সঙ্গীতের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। অবশ্য কাদিরিয়া ও শাত্তারিয়া সম্প্রদায় সঙ্গীতচর্চায় শর্তারোপ করেছে। আবু নসর সারাজ, ইমাম গাজ্জালী, শেখ আলি বিন উসমান হুজুইরী(কাশফ উল-মাহজুব লেখক, এটি ফারসি ভাষায় সূফীতত্ত্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ), ফরিদউদ্দীন আত্তার, শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, খওয়াজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, জালালউদ্দিন রুমী প্রমুখ সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন।
.
০২.
সুফীরা প্রেমধর্মে বিশ্বাসী। কিতাব-উল-লুম্মায় আবু নসর সারাজ এবং এহিয়া-উল-উলুম ও কিমিয়া-ই সাদত গ্রন্থদ্বয়ে ইমাম গাজ্জালী সঙ্গীতের তাত্ত্বিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। আচারবাদীদের কাছে যা গর্হিত, মরমীয়াদের কাছে তা-ই কাম্য। এখানেই যাহের ও বাতেনের পার্থক্য। অতএব তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সঙ্গীতে মানব-মনের একটি মহত্তর প্রকাশ স্বীকৃত হয়।
গাজ্জালীর মতে (কিমিয়া) সঙ্গীত হচ্ছে পাষাণে নিহিত সুপ্ত আগুনের মতো। ঘর্ষণে শিলা থেকে যেমন আগুন বের হয়, এবং তা গোটা অরণ্য দগ্ধ করে, তেমনি সঙ্গীতের স্পর্শে আত্মার আগুন জ্বলে উঠে। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে বিশুদ্ধ ও রূপবান হয়, তেমনি হৃদয়কে সঙ্গীতের আগুন মুকুরে পরিণত করে, যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় জগতের সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যের রূপভেদে তাত্ত্বিক নাম: জমাল, হুসন ও তনাসুব। সঙ্গীত সৌন্দর্যকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়। তার মতে নিঃসঙ্গতায় মানুষ বাঁচাতে পারে না। সে সঙ্গীত খোঁজে। যাকে ভালোবাসে তাকেই সে পেতে চায় সঙ্গীরূপে। কাজেই প্রেম বা মহব্বত করার জন্যে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। যাকে পেলে আর কিছুই পাবার থাকে না, একের মধ্যে সবকিছুই মেলে, সব অভাব মেটে; তার সঙ্গেই তো প্রেম করা, তাঁকেই সাথী হিসেবে পাওয়ার কামনা করা উচিত। বিশেষ করে, আল্লাহও মানুষের প্রেমকামী :
ক. আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, তারা আল্লাহকে ভালোবাসবে।
খ, আল্লাহপ্রেম, পিতামাতা, সন্তান ও ভ্রাতৃপ্রেমের চেয়ে বেশি।
গ, রসুলও বলেন : যে তার আর সব সম্পদের চেয়ে বেশি করে আল্লাহ ও রসুলকে ভালোবাসতে না পারে, সে ধার্মিক নয়। শরীয়তপন্থীদের মতো সূফীরাও সঙ্গীতে অধিকারী-ভেদ মানে। ৫৬ক তাই আবু নসর সারাজ যোগ্যতানুসারে শ্রোতারা তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছন :
ক. মুবদী ও মুরীদ (Beginners and disciples) খ. মুতওয়াসসিত্ ও সিদ্দিকী (Advanced and Purists). গ. আরেফিন (Mystics).
জুনাইদ বাগদাদীও স্থান (Makan), কাল (Zaman) ও পাত্র বা সঙ্গকে (Akhwan) সঙ্গীত শ্রবণের ঔচিত্য ও অনৌচিত্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। হুজুইরীরও এই মত। তিনিও আমাদের জন্যে নয়,অধ্যাত্মচিন্তা উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে গীত বা শ্রুত সঙ্গীতই বৈধ বা বাঞ্ছনীয় বলেছেন।
যদিও হযরত আয়েশা প্রমুখের দোহাই ও নজির দিয়ে সঙ্গীতকে বৈধ করে নেবার প্রয়াস ইসলামের উন্মেষ-যুগ থেকেই শুরু হয়েছে, তবু বৈধ বলার চেয়ে অবৈধ বলার পক্ষে তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি যে বেশি, তা কেউ সহজে অস্বীকার করে না। আয়েশা-সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় : ঈদের দিনে, বিবাহোৎসবে এবং অন্যদিনে নির্দোষ সঙ্গীত গীত ও শ্রুত হতে পারে। আর অধ্যাত্মসাধনার বাহন হিসেবে সঙ্গীতের উপযোগে আন্তরিক বিশ্বাস রেখে কেউ যদি সঙ্গীতচর্চা করে কিংবা সঙ্গীতকে চর্যা হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে তার পক্ষে সঙ্গীত অবৈধ হতে পারে না। এমনি সব বিশ্লেষণ ও বিবেচনার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজে সঙ্গীত বৈধ হয়েছে।
অবশ্য পাপ বলে জেনেও যেমন মানুষ লোভের বশে আর দশটা অপকর্ম করে, মুসলমানেরাও তেমনি মানুষ হিসেবে ফাসেকী জেনেও সঙ্গীতকে পরিহার করতে পারেনি। শোনা যায়, বাদশাহ কুতবউদ্দিন আইবেক সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন; ফলে তাঁর আমলে রাজ্যের জনগণও সঙ্গীতানুরাগী হয়ে উঠে। ইলতুতমিসের সময় গোঁড়া মুসলিমরা রাজকীয় হুকুমে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেয়ার জন্যে ইলতুতমিসকে অনুরোধ করে। ইলতুতমিস কুতুবউদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধাবশে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করাই স্থির করলেন। ফলে মুসলিম শাসনের গোড়া থেকেই ভারতে সঙ্গীত মুসলিম-সমাজে প্রশ্রয়। পায়।
পাক-ভারতে চিশতিয়ারাই মনেপ্রাণে সঙ্গীতকে সাধন-ভজন ও বোধনের মাধ্যম করেছিলেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (১১৪২-১২৩৮) সুলতান মুহম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সঙ্গে তিনি ১১৯২ সনে ভারতে আসেন এবং হিন্দুতীর্থ পুষ্করের কাছে আজমীরে খানকা তৈরী করেন।
.
০৩.
ভারতের এক বৃহত্তর অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরভারতে এই চিশতিয়ারাই ইসলাম প্রচার করে। ইসলামের আনোদানকারী বলে তাঁদের প্রধানরা চেরাগী বলে অভিহিত হন। এঁদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন দেহলবী, ফরিদুদ্দীন শকরগঞ্জী, জালালুদ্দীন পানিপথী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া বলখী (প্রকৃত নাম মুহম্মদ বিন আহমদ বিন দাখিয়াল অল বোখারী), মুহম্মদ সাদিক গুনগুবী ও শেখ সলিম ফতেপুরীর মাহাত্ম্য আজো অম্লান। আমীর খুসরুও বুজুর্গ বলে খ্যাত। এরা সবাই সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন। এবং এঁরা হিন্দুদেরও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। পঞ্চপঞ্জ চিশতিয়া গ্রন্থে সঙ্গীতানুরাগ ও সঙ্গীত সম্বন্ধে এঁদের ধারণার আলোচনা রয়েছে। শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী বলতেন–যারা সঙ্গীতের বিরোধিতা করে তারা রসুলের ও সাহাবীদের জীবন ও আচার সম্বন্ধে অজ্ঞ। তিনি তাঁর সন্তানকে সঙ্গীতচর্চায় উৎসাহিত করতেন।