ট. আব্বাস ইবন মালিক বলেছেন : রসুল হুদা (কাফেলা চলাকালীন গান-উটগীতি) শুনতেন। এবং আয়েশা স্বয়ং মেয়েদের জন্যে এবং আনাসের ভাই বারা-ইন মালিক পুরুষদের জন্যে হুদা গাইতেন।
ঠ. রসুল আবিসিনিয়াবাসীদের বলেছিলেন : আরফাঁদ গোত্রের সন্তানেরা, তোমাদের অনুষ্ঠান (গান-বাজনার Performance Acrobatic) চালিয়ে যাও। (দুনাকুম ইয়া বনি আরফাদা ববাজি-মাশুগুল বাঁশি।]
ড. আবিসিনীয়গণের (জঙ্গীদের) ক্রীড়া ছিলো নাচ-গান। (বাজি-ই-জঙ্গীয়ান–রক্স ওয়া সুরূদ বুদা।
ঢ, আল্লাহ্ মিষ্টি কণ্ঠস্বর বঞ্চিত কোনো নবী পাঠাননি। মা বাসাল্লাহু নবীয়ান ইল্লা হসন আসসও।
ণ. মিষ্টিস্বরে কোরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। [জাইয়িনুল কোরআন বি অসওয়াতিকুম।]।
ত, আল্লাহ্ নবীদের মিষ্টিসুর যেভাবে অনুমোদন করেছেন, এমনটি আর কিছুই করেননি। (মা আজান আল্লাহুতায়ালা লিশায়িন কমা আজানা আন নবীয়িতন হন অসসওত।]
খলিফাদের মধ্যে হযরত আবুবকর সঙ্গীত নিষিদ্ধ মনে করতেন। হযরত উমরও সঙ্গীতবিরোধী ছিলেন, তবে শেষের দিকে তিনি আর তেমন রুষ্ট হতেন না।
হযরত উসমান গান শুনতেন। নিজে গাওয়া গর্হিত মনে করতেন। তাঁর প্রিয় গায়কের নাম ছিলো আবু সাজ্জাদ। হযরত আলি নিজে কবি ছিলেন এবং ললিত কলার সমাদর করতেন। কিন্তু তিনি পেশাদার গায়িকাদের ঘৃণা করতেন।
মোটামুটিভাবে বলতে গেলে খলিফারাও সঙ্গীত বৈধ বলে মনে করতেন না। আরবদের বিশ্বাস শয়তান বড় শিল্পী। ভারতে যেমন সঙ্গীতাদি শিবপ্ৰােক্ত বলে ধারণা, তেমনি শিল্প শয়তান উদ্ভাবিত বলেই আরবদের বিশ্বাস। রসুলের উক্তিতেও এই শয়তানের কথা আছে।
বিশেষ করে ইসলাম-পূর্ব আরবে মদ, নারী ও সঙ্গীত নিয়েই জনগণ মত্ত থাকত, ইসলামের সংগ্রাম ছিল এসব অনাচারের বিরুদ্ধে। কাজেই যৌন-আবেদনমূলক সঙ্গীত ও পেশাদার গায়িকার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। তাই কোরআনে, হাদিসে ও ফেকায় সঙ্গীতের প্রতি বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি কবি ও গায়কের সততায় ও সত্যবাদিতায় অবিশ্বাস করার স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে :
ক. বিপথগামীরাই কবির অনুসরণ করে। [ আশু-অরাউ ইবাত্তাবি-উঁহুমুল গাউন।]
খ. [ওয়া মিনান্নাস-ই-মাই ইয়াতারি লাহওয়াল হদিসি লি য়ুদিল্লা আন সবিলিল্লাহ্।]
গ. রসুল বলেছেন : [ ইহজারুল গিনা ফাইন্নাহু মিন ফি, লি ইব্লিস ওয়া হুয়া শিরকুন ইনদাল্লাহি তায়ালাওয়ালা তাগান্নি ইল্লি শয়তান।] : সঙ্গীত থেকে আত্মরক্ষা কর।
এটি ইব্লিসের লক্ষণ; এটি শিরক। শয়তান ছাড়া কেউ গান গায় না।
ঘ. গায়ক ও শ্রোতা আল্লাহর অভিশপ্ত। (লা আনল্লাহ্ অল মুগান্নিআতা ওয়াল মুগান্না লাহু।
ঙ. রসুল গান করা ও শোনা নিষিদ্ধ করেছেন। [ আনিল গিনা-ই-ওয়াল ইসতিমা-ই আনিল গিনা।]
সব প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে আরব-মনের সাঙ্গীতিক প্রস্রবণ ক্ষীণধারায় ৬৬১ খ্রীস্টাব্দ অবধি বইতে থাকে। তারপর খলিফা মুয়াইয়া (মাবিয়া) যখন শাসনাধিকার পেলেন, তখন থেকে আরব সমাজে সাঙ্গীতিক প্রবণতা বাড়তে থাকে। কেননা, মুয়াইয়া নিজে সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন এবং স্বয়ং গায়িকা পুষতেন। তবু সাহাবী ও ইমামদের মধ্যে সঙ্গীত ব্যাপারে কখনো মতদ্বৈধতা ঘোচেনি। স্থান, কাল, প্রয়োজন ও প্রবণতা অনুযায়ী কেউ বলেছেন যায়েজ, কেউ করেছেন নিষেধ।
ইমাম আবু হানিফা যন্ত্রসহযোগে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা গান শুনতেন। ইমাম মালিকও গান উপভোগ করেছেন। ইমাম শাফী তাঁর কিতাবুল উলুম-এ সঙ্গীতকে সমর্থন করেছেন। গাজ্জালী তাঁর কিমিয়া-ই-সাদৎ-এ কিতাবুল উলুম সম্বন্ধে মন্তব্যসূত্রে বলেছেন যে শাফী সঙ্গীতের পক্ষপাতী ছিলেন। ইউনুস-বিন-আবদুল আলা একবার সঙ্গীত সম্বন্ধে ইমাম শাফীকে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে শাফী বলেন : হেজাজে আমি কাউকে সঙ্গীতবিরোধী দেখিনি।
ইমাম আহমদ-বিন হাম্বলের দুই পুত্রের উক্তিতে প্রকাশ, তিনি সঙ্গীত উপভোগ করতেন। নির্দোষ ও মহম্ভবের গানের প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন না। মোল্লা আলি কার হানাফী বলেন : চার ইমাম ও মুজতাহিদগণ সঙ্গীত উপভোগ করতেন।
আসলে কোনো ইমামই সঙ্গীতকে যায়েজ বলেননি। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে কখনো কখনো তাদের সঙ্গীত শুনতে বা অনুমোদন করতে দেখা গেছে মাত্র। কিন্তু তাঁরা স্পষ্ট মত দিয়েছেন সঙ্গীতের বিরুদ্ধে। সঙ্গীত হৃদয়ে মন্দভাব জাগিয়ে তোলে, এ-ই হচ্ছে সাধারণ ধারণা। অতএব সঙ্গীত ফাসেকী। যারা চরিত্র ও সাধনা বলে বলীয়ান; কেবল তাদের পক্ষেই সঙ্গীতচর্চা বৈধ হতে পারে। রসুল বলেছেন : সঙ্গীত হৃদয়ে উত্তেজনা আনে, যেমন জল (জলের স্পর্শে মাটির বুকে) ঘাস জন্মায়। এই মত সাধারণভাবে খলিফা, সাহাবী, তাবিন ও ইমাম সবাই পোষণ করতেন। কাজেই গীত গওনে-শ্রবণে অধিকারী ভেদ আছে। সুকণ্ঠ গায়ক যে সুরের জাদুকর এবং মহম্ভাবের সঞ্চারক, সে তত্ত্ব দাউদ নবীর কাহিনীর মধ্যে রয়েছে। তখন গান ফাসেকী নয় সাদেকী। অবশ্য Fakihani (ফাঁকিহানী] বলেন, আমি কোরআনে, হাদিসে কিংবা রসুলের জীবনে প্রত্যক্ষভাবে তথা স্পষ্টভাবে সঙ্গীতবিরোধী কিছু পাইনি।
গায়িকার প্রতি রসুল, খলিফা, সাহাবী, তাবিন, ইমাম প্রভৃতি সবাই ছিলেন বিরূপ। শিয়ারাও সঙ্গীতবিরোধী।