দেবতা ও উপদেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্যেও গায়িকার গানই কার্যকর বলে মনে করা হত। এজন্যে তাদের অপর নাম ছিল দজিনা (Dajina) বা মদজিনা (Madjina)। তাই ইসলাম পূর্বযুগের আরবে নারীর প্রভাব সম্বন্ধে : R.A. Nicholson বলেছেন : Wise women inspired the poets to sing and warriors to fight…. কাফেলায় কিংবা সরাইখানাতেও গায়িকা পোষা হত। আবুল ফারাজ ইসফাহানীর কিতাবুল আগানি ইবন, আবদুরব্বিহির (মৃত্যু : ৯৪০ খ্রী.) ইকদুল ফরিদ, ভৌগোলিক আল মাসুদীর কিতাবুৎ তানবিহ ওয়াল ইশরাক প্রভৃতি পুরোনো গ্রন্থে এবং কোরআনে-হাদিসে নানা প্রসঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত গায়কের নাম আমরা জানতে পাই। নজর বিন হাবিস, মালিক বিন যোবায়ের, হরায়রা, খুলায়দা, বিলাল হাবসী, শিরিন, সারা, কুরায়ানা, কুরিল্লা, আমর, হামজা প্রভৃতি।
আমরা ইসলাম-পূর্বযুগের আরবে উৎসবে-পার্বণে-হজে, অনাবৃষ্টি-অজন্মায়-দুর্ভিক্ষে, দেবতার আবাহনে, যুদ্ধে, জাদুতে ও ভাগ্যগণনায় গানের প্রয়োগ দেখেছি। তাছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে। আনন্দের উপকরণ হিসেবে গুঁড়িখানায়, সরাইতে ও কাফেলায় পেশাদার গায়িকা পোষার রীতিও ছিল অবাধ। এসব গায়িকার সবাই আরব ছিল না; আবিসিনিয়া, গ্রীস ও ইরান থেকেও আসত। এমনকি রসুলের আমলের যুদ্ধে ড্রামবাদক ছিলেন একজন ভারতীয়, তার নাম বাবা Sawandik।
এতে বোঝা যায় আরবেরা সঙ্গীতপ্রিয় জাতি। কাজেই ইসলামোত্তর যুগে সঙ্গীত-বিমুখ হওয়া তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য কৃচ্ছু সাধনার মতোই দুষ্কর ঠেকেছিল। ফলে প্রবৃত্তির প্রতিকূল সংগ্রামে তারাও বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারেনি। অবশ্যম্ভাবীরূপে শুরু হল খোঁজাখুঁজি ও ব্যাখ্যা-নিরীক্ষা কোরআন-হাদিসের সমর্থন লাভের আশায়। এবং অভীষ্ট ফল লাভে দেরি হল না।
কোরআন থেকেই সঙ্গীতে আনা আয়াতের অনুমোদন বা অনুমোদনের আভাস ইঙ্গিত বের করা হল :
ক. নিশ্চয়ই গাধার ডাকই সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বর।
খ. তিনি ইচ্ছেমতো তাঁর সৃষ্টিতে বৃদ্ধি করেন সুন্দর স্বর।
গ. এবং কোরআন আকর্ষণীয় করে পড়ো।
এমনি আরে অনেক আয়াত থেকে পরোক্ষ ইঙ্গিত২৪ সংগ্রহ করে সঙ্গীতের সমর্থনে ভাষ্য তৈরি হয়েছে। আবার একই পদ্ধতিতে সঙ্গীতবিরোধী তথ্যও উদ্ধার করেছে সঙ্গীতবিমুখ গোঁড়ারা।
হাদিস থেকেও পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে প্রচুর। এতে কেবল বিতর্ক বিস্তৃত ও জটিলই হয়েছে; সবার পক্ষে গ্রহণীয় কোনো মীমাংসা মেলেনি।
হাদিসে সঙ্গীতের সমর্থন
ক. যারা দাউদের সুকণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করে, তারা আবু মুসা আল আশারীর কণ্ঠ শুনুক।
খ. রসুল স্বয়ং শ্লোক বা পদবন্ধ রচনা করে গীতিসুরে আবৃত্তি করেছেন :
১। ইন আন্তা ইল্লা অসবুউ দুমিতি
ওয়া ফি সবিলিল্লাহি মা লকিতি।
(হে রক্তপূর্ণ আঙুল, তুমি আল্লাহর রাস্তায় গিয়েছ)।
২। আতাইকুম আতাইকুম ..
ফাহাইয়ানা ওয়া হাইয়াকুম।
(আমি তোমাদের কাছে এসেছি, এসেছি, আল্লাহ আমাকে এবং তোমাদেরকে দীর্ঘজীবী করুন)
রসুলের ওফাতে শোকাভিভূতা কন্যা ফাতেমাও পদ রচনা করে বিলাপ করেছিলেন:
৩। সব্বত আলাইয়া মসাইবু লউ ইন্নাহা–
সব্বত অলালাইয়ামি শররফা লাইয়াহিয়া।
আমার উপর বিপদপাত হয়েছে। যদি তা দিবালোকের উপর পড়ত, তা হলে তা রাত্রি হয়ে যেত।
গ, হযরত আয়েশা বলেছেন : রসুলের উপস্থিতিতে তার সাহাবীরা পরস্পরকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। রসুল মৃদু হাসতেন।
ঘ. আমর বিন আশশারীয়া বলেছেন : আমিরসুলের সামনে উমাইয়া বিন আবিল সাতের শতেক শ্লোক ((verse) সবই আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। রসুল বলছিলেন, আবৃত্তি করতে থাকো এবং মন্তব্য করেছিলেন উমাইয়া তাঁর কবিতার ভাবে প্রায় মুসলিম হয়ে গেছে।
ঙ. আয়েশা রসুলের আর এক উক্তি উল্লেখ করেছেন : তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও, এতে তাদের জবান মিষ্টি হবে।
চ. তিরমিজীতে বর্ণিত আছে : রসুল এক যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে এক মহিলা ডফ (ডাফ) বাজিয়ে গান গেয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা করতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন।
ছ, তবরানি (Tabarani) তাঁর মজমি কবির-এ বর্ণনা করেছেন : একদিন রসুল নিজেই আয়েশায় কাছে এক গায়িকা এনে হাজির করেন এবং আয়েশার অভিপ্রায়-ক্রমে সে গান গাইল, রসুল শুনে (মুগ্ধ হয়ে) মন্তব্য করলেন : নিশ্চয়ই শয়তান (মিষ্টিস্বরের অধিকারী) তার নাসারন্ধ্র দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। কি নফখাশ শয়তানু মেন খারাইয়া।
জ, আয়েশা এক ঈদের দিনে এক আনসার মেয়ের গান শুনছিলেন, রসুল তখন বিছানায় শায়িত ছিলেন। আবু বকর এসে গান-বাজনা হচ্ছে দেখে আয়েশাকে তিরস্কার করে বললেন : শয়তানের যন্ত্র বাজুছে রসুলের ঘরে! রসুল বললেন : তাকে করতে (শুনতে) দাও আবুবকর, আজ ঈদের দিন। [ আবু বকর: মিযমারুশ শয়তানি ফি বায়ত-ই-রসুলিল্লাহ্। রসুল : দাহুন্না ইয়া আবুবকর, ফা ইন্নাহা আইয়ামু ঈদ।]
ঝ, আয়েশা একবার এক এতিম মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের উপহার সামগ্রীর সঙ্গে গায়কও পাঠানো হয়েছিল, রসুলের সম্মতিক্রমে এবং রসুল নিজেও এ উপলক্ষে একটি গান রচনা করেছিলেন :
আনা নবীউ লা কঝিব।
আনা ইব্ন আবদ-ইল মুত্তালিব।
ঞ. একবার রসুলের উপস্থিতিতে আয়েশাকে কয়েকটি গায়িকা ডফ বাজিয়ে গীত শুনাচ্ছিল, উমর এসে বললেন, সঙ্গীত হচ্ছে শয়তানের বিদ্যা,অতএব হারাম। রসুল ভিন্নমত প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে উমরও সঙ্গীত উপভোগ করতেন।