আরবদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ কেবল গতানুগতিক চর্চায় নিঃশেষ হয়নি, বরং ইরানী, নবেতিক, সিন্ধি, গ্রীক প্রভৃতি সঙ্গীত পদ্ধতির অনুশীলনে ঋদ্ধ ও উন্নত করার প্রয়াসেও অভিব্যক্ত হয়েছে। তফাতের মধ্যে এই : মুখ্যত মানসপ্রবণতাবশে এবং কিছুটা শাস্ত্রীয় প্রভাবে তা কেবল সৌন্দর্যানুশীলন ও আনন্দের উপকরণ রূপেই গৃহীত হয়েছে। আব্বাসীয় পতনযুগে মুসলিম-সঙ্গীতে আবার ধর্মীয় আবেগ যুক্ত হয়েছে। আসলে ইরানী প্রভাবে সূফীমতের প্রসারেই সঙ্গীত হয়ে উঠল বোধন-গীতি, সাধনসঙ্গীত ও ভজন। কেননা আরবে সঙ্গীতচর্চা ইসলামোেত্তর যুগে অবাধ ছিল না, তার উপর সৌন্দর্যপিপাসা আনন্দ-অন্বেষা ও স্বপ্নালুতাই ছিল তাদের সাঙ্গীতিক প্রয়াসের মূলে।
এদের লক্ষ্য কখনো সঙ্গীতে অধ্যাত্ম আবেগ সৃষ্টির দিকে ছিল না। সমস্ত আরব ইতিহাস, তাহার ভাষা ও সামাজিক জীবন সংক্ষেপে যে একটি কথায় বলা চলে, তাহা হইল কল্পনাবিলাস ও খেয়াল। তাহাদের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ললিত কলায় এই কল্পনার যথেষ্ট নির্দশন বিদ্যমান। ইহাদের স্থাপত্য শিল্পের দিকে লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে যে, সুদৃঢ় ইমারত অপেক্ষা ইহা জটিল রূপকল্প এবং আলঙ্কারিক নকশামাত্র। ইহাদের চিত্রকলা বর্ণসমাবেশের প্রকাশ এবং ইহা সুসম্বন্ধতাহীন সুর সৃষ্ট এমন এক কাল্পনিক নকশা যাহাকে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধিয়া দেওয়া যায় না। সঙ্গীত সম্বন্ধেও ঐ একই কথা : শোভা-সৌন্দর্য, সুবৈচিত্র্য এবং অলঙ্করণই হইল ইহার মৌলিক উপাদান। Encyclopaedia of Islam গ্রন্থে সংকলিত মুসলিম স্থাপত্যাদি সম্বন্ধে লিখিত প্রবন্ধে Berchem ( বাৰ্চেম) এই দিকটারই বারবার উল্লেখ করিয়াছেন–সেখানে তিনি বলিয়াছেন আরবি য় শিল্পকলা প্রকৃতি নহে, প্রকৃতির স্বপ্ন। … সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলিমগণ শিল্পের জন্যই শিল্প হিসাবে আনন্দ ও সৌন্দর্যভোগের উপায় স্বরূপ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় উদ্বেল ইন্দ্রিয়ানুভূতির অবলম্বনরূপে সঙ্গীতের চর্চা করিয়াছিলেন এবং সেইজন্যই ইহার সমগ্রতা, ঔজ্জ্বল্য, ভব্যতা ও শালীনতা লইয়া ইহা বিশিষ্ট।
অতএব আর্য বলেই হোক কিংবা ভারতিক প্রভাবেই হোক অথবা জোরাস্ট্রীয় মতবাদের সংস্কার বশেই হোক, ইরানে মরমীয়াবাদের পরিণতি কালে সঙ্গীত ও নর্তন সাধন-ভজনের উপায়রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ইরানি মরমীয়াবাদ তথা সুফীমত কোনো ঋজু ও অবিমিশ্র দর্শন-উদ্ভূত নয়; এটি গ্রীক বৌদ্ধ খ্রীস্টান ইহুদী মানী ও বেদান্তদর্শনের মিশ্রণে এক জটিল ও বহুধা বিভক্ত মতবাদ। ইসলামের মতো বৌদ্ধধর্মেও নাচ-গান বাজনা নিষিদ্ধ ছিল বটে কিন্তু বৌদ্ধেরাও একই অনিবার্য কারণে তা মেনে চলেনি। ট্রানসকসিয়ানার বৌদ্ধরাই পরবর্তীকালের তুর্কী, পাঠান ও মুঘল মুসলমান। কাজেই তাদের রক্তেও বৌদ্ধগুরুবাদ ও যোগতান্ত্রিক সংস্কার সুপ্ত ছিল। এদিকে ভারতে কালক্রমে অনার্য যোগ-সাংখ্য-তন্ত্র ও আর্য কর্মবাদ আর জ্ঞানবাদের সংমিশ্রণে যে সর্বেশ্বরবাদমূলক বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ প্রশ্রয় পেল, তারই পরিণতিকালে ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে।
যদিও শঙ্কর-দর্শনের প্রভাবেই বৌদ্ধ-উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা পায়, তবু শঙ্করের জ্ঞানবাদ তথা মায়াবাদ লোকের জীবনচর্যায় ফলত ধর্মাচরণে বিশেষ গৃহীত হয়নি। কাজেই যোগতান্ত্রিক সাধনাই মরমীয়াবাদের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে শাস্ত্রীয় ধর্মও নানা মিশ্র মতে জটিল এবং আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরে বিপুল হয়ে উঠে। বেদান্ত দর্শনের প্রচ্ছায় গড়া এই আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতীকি কল্পনায় প্রকৃতির স্থান ছিল মুখ্য আর অলৌকিকতার প্রভাব ছিল অসামান্য। এজন্যেই ভারতীয় কলাশিল্প ধর্মসম্পৃক্ত; ইহা ধর্মের এবং ব্যাপকতর অবস্থায় সমগ্রজীবনের অনুগত। ভারতীয়দিগের নিকট কলাশিল্প সৌন্দর্যানুশীলন অপেক্ষা জীবনকে তাহার সামগ্রিক পূর্ণতায় এবং তাহার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীয় যাবতীয় রহস্যে উপলব্ধি করার মধ্যেই সমধিক নিহিত। অতলস্পর্শী ব্ৰহ্মতত্ত্বের রূপায়ণ হইল ভারতীয় ললিতকলার জাগ্রত লক্ষ্য। ৫
ইসলাম ও সঙ্গীত *[* এই অংশটুকুর উপকরণ ডক্টর মাখন লাল রায় চৌধুরীর Music in islam: JASBLetters & science 1957 থেকেই বিশেষভাবে সংগৃহীত।]
ইসলাম-পূর্বযুগে অন্য মানুষের মতো আরবেরাও ছিল সঙ্গীতপ্রিয়। আরবি ভাষায় গিনা, মুসিকী ( গ্রীক) এবং সামা ( সিরীয়)–এই তিনটে শব্দ সঙ্গীতবাচক। আরবে পেশাদার গায়িকারা কইনাৎ ( Qainat) কিংবা কিয়ান ( Qiyan) নামে অভিহিত হত। দেশী গায়িকা ছাড়াও আবিসিনিয়া থেকে অনেক গাইয়ে-মেয়ে আসত। এরা সমাজ-জীবনের অঙ্গ ছিল। ইসলাম পূর্বযুগের সঙ্গীতযন্ত্রের মধ্যে আমরা মিযহার (Lute), মিযাফা ( Psalter), কুসাবা (Flute), মিযমার ( Reed pipe) এবং ডাফ (Tambourine), সুর, নাকাড়া, তবলা (অতবল) সঞ্জ, জলাজিল প্রভৃতির নাম পাই। মক্কার উকায-এ যে-বার্ষিক মেলা হত তাতে গোটা আরবের গোত্রগুলো জড়ো হত নিজেদের শৈল্পিক উৎকর্ষ দেখাবার জন্যে। মুয়াল্লাকাগুলো এখানেই গীত বা আবৃত্ত হত। তখনকার আরবে জাদুকর এবং গণকরাও তাদের পেশা চালাত গানের মাধ্যমেই। হজ উদযাপনের সময়ও গান চলত, তার রেশ রয়েছে তাহলিল ও তালবিয়ায়। আশরিক সবির কয়মা নুঘীর–এই আয়াত এখনো সুর করেই পড়া হয় মীনায় ইফাদা করবার সময়। আযানও ইসলাম-পূর্বযুগের প্রথার অনুসরণ। নারী-পর্দাপ্রথা চালু মা-থাকায় রসুলের আমলেও নারীরা উৎসবে-পার্বণে-যুদ্ধে গানে-বাজনায় অংশগ্রহণ করত। ওহুদের যুদ্ধেও নাকি রণগীতি গেয়েছিল নারীরাই।