কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধ। বলতে গেলে যুক্তির অনুপস্থিতিই বিশ্বাসের জন্মদাতা। যুক্তি দিয়ে তাই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা চলে না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তির অবতারণাও তেমনি বিড়ম্বনাকে বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়।
আজকাল একশ্রেণীর জননেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকল্যাণকামী মনীষী শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও নীতিবোধের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান কামনা করছেন। নতুন ও পুরোনোর, কল্পনার ও বাস্তবের, যুক্তির ও বিশ্বাসের অথবা দুই বিপরীত কোটির সত্যের সমন্বয় সাধন করে নতুনে ও পুরাতনে, সত্যে ও স্বপ্নে সঙ্গতি স্থাপনে তারা আগ্রহী। তাই পুরোনো ধর্ম ও পুরোনো নীতিবোধের সঙ্গে আধুনিক জীবন-চেতনার মেলবন্ধনের উপায় হিসেবে তারা বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মশিক্ষা দানেও উদ্যোগী। কিন্তু এর পরিণাম যে শুভ হবে না–অন্তত যে হয়নি তার প্রমাণ পাদ্রি স্থূল ও নিউস্কিম মাদ্রাসা।
অবশ্য উক্ত শ্রেণীর চিন্তাবিদদের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত। তবে তাঁরা বিভ্রান্ত এ-ই যা। য়ুরোপে যারা বৈজ্ঞানিক সত্যর আবিষ্কারক ও দার্শনিক সত্যের প্রবর্তক তাঁরা হয় নাস্তিক নয়তো সংশয়বাদী। আমরা গ্রন্থের মাধ্যমে তাঁদের বাণীই শুনি এবং চোখ মেলে দেখি তাঁদেরই কৃতি। অথচ সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাই যুবরাপীয় সাধারণ মানুষের দিকে–যেন এরাই এ কৃতিত্বের দাবীদার। এবং দেখি যে, এরা জীবনে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ও ধর্ম ছাড়েনি। কাজেই আমরাই বা ছাড়ি কেন? মনে ভাবি, বিজ্ঞানে-বিশ্বাসে বুঝি বিরোধ নেই। দুটোর সমন্বয়েই যেন সম্ভব হয়েছে য়ুরোপের প্রগতি ও ঐশ্বর্য, প্রাপ্তি ও প্রতিষ্ঠা। এমনি একটা ভুল অথচ দৃঢ়মূল ধারণার বশেই আমাদের শিক্ষাবিদদের এই সৎ-প্রয়াস। বহতা নদীর দুইকূল রক্ষা করা যায় না এবং দুই নৌকায় পা রাখাও বিপদসঙ্কুল–এই আপ্ত বাক্যদ্বয়ে আজো আস্থা রাখা নিরাপদ। তাই বিশ্বাস অথবা বিজ্ঞান–দুটোর একটা ছাড়তেই হবে। নইলে মানুষের চারিত্রিক বিকৃতি বাড়বে বই কমবে না।
অবশ্য এককালে বিশ্বাসই মানুষের চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানুষ দুঃখে-বিপদে প্রবোধ ও শক্তি পেয়েছে সে-পথেই। তখন কিন্তু জ্ঞানের প্রসার হয়নি, তখন বিজ্ঞানও হয়নি জীবন-যাত্রার অবলম্বন। বিশ্বাসই ছিল মানুষের অভয় শরণ। আজ যুক্তি ও বিজ্ঞানের মোকাবিলায় বিশ্বাস দেউলে। বিশ্বাসের মহিমা কীর্তনে আজ আর কী ফল! চালু ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রতারিত করা অসুস্থ মনেরই পরিচায়ক মাত্র।
যারা মানুষের নৈতিক জীবনের মানোন্নয়ন-বাঞ্ছয় ধর্মশিক্ষা কামনা করেন, তাঁদেরকে এ আশ্বাসটুকু হয়তো সঙ্গত কারণেই দেয়া যায় যে, যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞান-চেতনার মাধ্যমেও জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে নতুন নীতিবোধ জাগানো সম্ভব এবং নৈতিক জীবনও উন্নততর করা দুঃসাধ্য হবে না। কেননা মানুষের মানবিক গুণের বিকাশ ত্বরান্বিত হয় সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান পাঠে। যুক্তিপ্রবণতার উদ্ভব ও বৃদ্ধি এতেই হয়। আর বিজ্ঞান করে যুক্তিনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ।
কিন্তু এতেও মাকড়সার জালের মতো এক সূক্ষ্ম বাধা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই বৃত্তিমূলক বিদ্যার অনুরাগী ও পক্ষপাতী। তারা জনগণকে ও ছাত্রকে বৃত্তিমূলক বিদ্যার উপযোগ সম্বন্ধে সচেতন করিয়ে দেয়ার প্রয়াসী। পেশাগত লক্ষ্য স্থির করেই পড়–এ-ই হচ্ছে তাদের স্লোগান। শুনে শুনে ছাত্রছাত্রীরাও লেখাপড়াকে পেশা শিক্ষা বলেই মনে করে। বিদ্যার্জন যেন ভাবী পেশারই Training। ফলে লেখাপড়া করে বিদ্যার্জন করে শিক্ষিত হও, মানুষ হও এমন কথা আজকালকার ছেলেমেয়রা শুনতেই পায় না। মানবিক বৃত্তির পরিশীলন, পরিশ্রুতি ও বিকাশের জন্যেই বিদ্যার্জন এবং বিদ্যার্জনেই যে বিদ্যাচর্চার শেষ –এর বৈষয়িক গুরুত্ব থাকলেও তা যে ছাত্রছাত্রীদের অমন করে জানিয়ে দিতে নেই, এ যুগে সে কথা কেউ স্বীকারই করেন না। ফলে লেখাপড়া শিখে লোক যন্ত্রীই হচ্ছে, মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে না। তাই সমাজে এখন লেখাপড়া-জানা যুবকেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-অধ্যাপক বা সরকারি-সওদাগরী কর্মচারী হয়। সততায়, প্রতিবানতায়, পরার্থপরতায়, উদারতায়, মানবিকতায় ও বিচারশীলতায় মানুষ হয় কৃচিৎ। এর পরিণাম যে সমাজের পক্ষে শুভ হচ্ছে না, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যাকে এভাবে বিষয়বৃত্তির অনুগত করে সীমিত লক্ষ্যে নিবদ্ধ রাখা আর মানবমনীষা ও মানবিক বৃত্তিতে জৈবিকতার সংকীর্ণ সীমায় নিয়ন্ত্রিত করা একই কথা। এতে প্রাণ বাঁচে কিন্তু মন নিশ্চিতই মরে এবং প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।
সঙ্গীত ও অধ্যাত্মসাধনা
মানস প্রয়োজনে ও জৈবধর্মের তাকিদে সঙ্গীত মানবসমাজে স্বতোউদ্ভূত। সে কারণেই কৌম সমাজে art আর ritual অভিন্ন। আদি সমাজে গান কর্মেরই অঙ্গ ছিল–মুখে গান, হাতে কাজ। গানের ছাদে হাত চলে, তাই আজো ছাদ নির্মাণে গান অপরিহার্য। এভাবে জীবনকে কলার অনুগত করে কিংবা কলাকে জীবনানুগ করে সাধনার শুরু হয়েছে কবে থেকে তা কেউ বলতে পারে না। তবে জানা অতীতের গোড়ার দিকের কুয়াশার প্রলেপেও যা ঢাকা পড়েনি তা হচ্ছে : কলাশিল্পের ও অধ্যাত্মজীবনবোধের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই চিত্রকলা ভাস্কর্য নৃত্য ও গীতি এমনকি স্থাপত্যও একই উৎসের ইঙ্গিত দেয়। সঙ্গীতের সঙ্গে জীবনের এমনি গভীর যোগ রয়েছে বলেই ইসলামের সুকঠোর নির্দেশও আরবেরা বেশি দিন মেনে চলতে পারেনি। ইসলামের উন্মেষের মাত্র কয়েক বছর পরেই উমাইয়াদের আমল থেকেই সঙ্গীতচর্চা প্রশ্রয় পেতে থাকে।