পার্থিব জীবনেও মানুষের আদি পাপের উৎস এই কামুকতা। কাবিল-জীবনে পাপ এই কাম থেকেই উদ্ভূত। কাম থেকেই কাবিলের ঈর্ষার জন্ম, আর ঈর্ষা থেকেই আসে হাবিল-হত্যার প্রেরণা। সে-থেকেই কামানল আর রূপবহ্নি সংযম-সতর্কতা সত্ত্বেও পোড়াচ্ছে হৃদয়, দগ্ধ করছে গৃহ, পুড়ছে ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, রাজ্য ও সমাজ। সে-সব কথা অঙ্গারের অক্ষরে লেখা রয়েছে। রূপকথায়, কাব্যে, উপাখ্যানে ও ইতিহাসে এবং গানে, গাথায়, চিত্রে, নৃত্যে, নাটকে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে। এই সর্বভুক অগ্নির দহনের কথা বলে বলেই গাইয়ে-বাজিয়ে-লিখিয়ে-আঁকিয়ে চিরকাল কাঁদিয়েছেন, চিরকাল জ্বালিয়েছেন মানুষকে। আজো মানুষ তেমনি জ্বলছে, তেমনি কাঁদছে এবং . চিরকাল জ্বলবে আর কাঁদবে। মানব সৃষ্টির সঙ্গে তার শুরু আর প্রলয়ে হবে তার শেষ। যৌনবোধ ও যৌনতা জৈবিক বলেই এর নিয়ন্ত্রণ সমস্যাও জটিল এবং দুঃসাধ্য। তাই বলে মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের হাতে-প্রকৃতির খেয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল না। এই জ্বালা ও কান্না, এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত প্রতিরোধ-লক্ষ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যৌনজীবন। মানুষের এই শুভবাঞ্ছ অনেকখানি সাফল্য পেয়েছে বিবাহ-বন্ধনে। এভাবে মানুষে মানুষে গড়ে উঠেছে দাম্পত্য ও আত্মীয়তা এবং সে-সূত্রে গড়ে উঠেছে পরিবার, পরিজন, গ্রাম, গোত্র ও সমাজ। সমাজ পেয়েছে স্থিতি ও শৃঙখলা। বেশ্যাবৃত্তিও হয়েছে দাম্পত্য সম্পর্কের পরিপূরক এবং সে-সূত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক।
পুরুষ-ভোগ্য নারীর সতীত্বের ধারণাও এর পরোক্ষ ফল। নারীর একনিষ্ঠতাই সতীত্ব। পুরুষের এমন সংযম ও একনিষ্ঠতার প্রয়োজন নেই। তারা বয়েস কালে দোষ যা করে, তা নিন্দনীয় হলেও তেমন ঘৃণ্য ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়। পুরুষ-প্রধান সমাজে পুরুষ নিজেদের জন্যে এ সুবিধেটুকু রেখেছে। নারী তার কাছে সোনা-রুপার মতো মূল্যবান ভোগ্যসম্পদ। সব মূল্যবান সম্পদই অপরের লোলুপতা ও অপহরণ-বৃত্তি জাগায়। তাই নারীকে লোভীর লোলুপ ও লুব্ধ দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হয়। তার একনিষ্ঠতা না থাকলে মালিকের স্বার্থে ও চিত্তে ঘা লাগে। এই এক-লগ্নতা তথা মালিক-নিষ্ঠার নাম সতীত্ব।
যৌনজীবনের এই সামাজিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ মানুষের পক্ষে শুভই হয়েছে। দুনিয়াব্যাপী সভ্য ও বর্বর মানুষের হৃদয়-বৃত্তির বিকাশ ও প্রকাশ সম্ভব হয়েছে এই নিয়ন্ত্রণের ফলেই। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে মানুষ মূলত তার এই বাধাপ্রাপ্ত যৌন-বৃত্তিরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, স্থূল ও সূক্ষ্ম, অমার্জিত ও পরিশ্রুত অভিব্যক্তি দিয়েছে। এভাবে কামের উন্নয়ন ও উত্তরণ ঘটেছে প্রেমে। এই যৌন অনুভূতি চেতন ও অবচেতন বোধে রূপচেতনা ও অনুরাগরূপে মানুষের চিত্তলোকে মহিমান্বিত বিভায় আত্মপ্রকাশ করেছে।
সহজেই বোঝা যায়, অবাধ কামচর্চা মানুষের অনুভব-উপলব্ধির জগৎ কিছুতেই প্রসারিত করতে পারত না। এ বাধা তাই আশীর্বাদ, এ সংযম তাই কাম্য; এ নিয়ন্ত্রণ তাই সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের মুখ্য মাধ্যম হয়েছে।
বলতে গেলে সর্বপ্রকার কলার আয়োজনই ভালো লাগার ও পেতে চাওয়ার অভিব্যক্তি দানের জন্যে এবং কাম্যজন থেকে ব্যবধানের ও বিচ্ছেদের কিংবা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাকে ধ্বনিত করার জন্যে। তাই দুনিয়ার সব শ্রেষ্ঠ কলাই বিরহজাত-বিরহবোধের দান। বিরহের ও অপ্রাপ্তির বেদনা ও কান্নাই ধ্বনিত হয়েছে সর্বত্র। এজন্যেই শৃঙ্গাররসই আদি, অকৃত্রিম ও সর্বহৃদয়বেদ্য রস।
ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানের অনুসরণে বলা চলে, অবদমিত যৌনবোধ মানুষের চিন্তায়, কর্মে ও অনুভবে রূপ পায়। অন্যকথায় মানুষের জীবনে যা-কিছু অভিব্যক্তি পায়, তার অনেকখানিই যৌনবোধের, যৌনবিকৃতির কিংবা নির্বিঘ্ন যৌনজীবনের দান।
বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এও হয়তো বলা যায় যে, মানুষের জীবন যতখানি রক্ত-মাংসের তথা দৈহিক বা জৈবিক, ততখানি ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও হিতবোধ লব্ধ নয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের যতখানি প্রাকৃতিক, এতকালের অনুশীলনেও মানুষ তার সিকিভাগও কৃত্রিম তথা স্বসৃষ্ট করতে পারেনি।
একটি প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা
উনিশ শতকের য়ুরোপে জাতীয়তাবাদ যখন উগ্ররূপ ধারণ করতে থাকে তখন কয়েকটি আনুষঙ্গিক চিন্তাও জাতীয়তাবাদীর মনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেগুলোর মধ্যে তিনটে প্রধান–স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সন্ধান ও সৃজন, স্বতন্ত্র সংস্কৃতির রক্ষণ ও উদ্ভাবন, এবং সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র অর্জন।
সাহিত্যের ব্যাপারে সমাজবাদীদের আগ্রহ আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা গণসাহিত্য সৃষ্টির গরজে লোক-সাহিত্যে ও লোক-ঐতিহ্যে অসামান্য গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। নিতান্ত কৌতূহলের আনন্দে যে Folklore-এর চর্চা শুরু হয় শতেক বছর আগে, তা-ই সামাজিক রাজনীতিক মতবাদ দৃঢ়মূল করবার অবলম্বন হয়ে উঠল। আবার সমাজ, সংস্কৃতি ও নীতিবোধের বিবর্তন ধারার ইতিহাসের উপকরণ-উপাদান হিসেবেও Folklore গুরুত্ব পাচ্ছে। আইরিশ, ইসরাইল ও নিগ্রো জাতীয়তা যেমন স্বদেশী ভাষা, ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্য অবলম্বন করে বিকাশ কামনা করছে, সমাজ-বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকরাও তেমনি Folklore-কে মানব-সভ্যতার ইতিহাস রচনার উপকরণ ও মানব-প্রকৃতি ব্যাখ্যার অবলম্বন করেছেন। কাজেই লোক-ঐতিহ্য ও লোক-সাহিত্য তথা Folklore আজ মানবিক প্রগতির উপকরণ ও উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।