পাঞ্জাবের বুলেহশাহ ও আমাদের লালন প্রভৃতি বাউল কবির সমগোত্রীয় ছিলেন লতিফ। সাধারণভাবে হয়তো বলা যায়–রুমী, জামী, হাফিজ প্রমুখ সূফী কবি এবং রামানন্দ, কবীর, দাদু। কলন্দর, রজব প্রভৃতির উত্তরসাধক ছিলেন শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই। ভিট শব্দের অর্থ টিলা, আর টিলাবাসী বলে ভিটাই এবং শাহর টিলাই হল ভিটশাহ।
সূফী বৈষ্ণবদের মতো পরমের বিরহবাধই শাহ লতিফের অধ্যাত্ম-প্রেরণার উৎস এবং পরমের সাথে মিলনই কবির সাধনার লক্ষ্য।
বৈষ্ণব কবি বলেন :
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন ন গেল।
লতিফও বলেন:
প্রিয়তমা মোরে ছাড়িয়া গিয়াছে।
হৃদয় আমার বিরহে বিধুর,
প্রেম থেকে আমি বঞ্চিত তাই
পরাণে বাজিছে বেদনার সুর।
এবং প্রেমিকের গানে না-পাওয়ার সুর চিরকাল তাই ধ্বনিত হয়।
কিংবা –
আমার হৃদয় একটি বহ্নিশিখা
অবিরাম জ্বলছে। সেই জ্বালিয়েছে
শিখাটি যাকে আমি ব্যাকুল হয়ে
খুঁজে চলেছি।
রবীন্দ্রনাথও বলেন :
আজিও কাঁদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।
সূফীরা প্রেমের রাহে ফানা হয়ে যেতে উপদেশ দেন। শাহ লতিফেও তাই পাই–হে পতঙ্গ, প্রেমের অনল তোমায় ইশারায় ডাকছে। ভয় পেও না তুমি, ঝাঁপ দাও নিঃসঙ্কোচে। সে-অনলে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হবে তোমার চিত্ত।
লতিফ আরো বলেন :
আশেক মাশুকে কোনো ভেদ নেই। সাগর আর ঢেউ যেমন মূলত এক হয়েও দুইরূপে দেখা দেয়, কিংবা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি যেমন দুই সুরে বেজে উঠে, আত্মা ও পরমাত্মাও তেমনি ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয় মাত্র।
লতিফ তাই বলেন :
তুমি বৃথাই দূরের পথে যাত্রা করছ; চেয়ে দেখ, বন্ধু তোমার কাছে রয়েছে রয়েছে তোমার মেঝের উপর। যাকে পাওয়ার জন্যে এত দুঃখ পাচ্ছ, সে তো তোমার ভিতরেই বাস করে। তাকে নিজের হৃদয়ের মধ্যে খোজো। তোমার পায়ের পর্যটন থামাও। এবার হৃদয়পথে মন চালাও। কেননা, পায়ে হেঁটে কচ্ছদেশে পৌঁছার সে সাধ্য নেই।
আমাদের বাউল কবিও তাই বলেন :
লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন।
তা না হলে কি সব নূরের তন
আদম তনকে সেজদা জানায়।
অথবা—
এ মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
যারে আকাশ পাতাল খোঁজো
এই দেহে তিনি রয়।
কিংবা–
দেহের মাঝে আছে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।
অথবা —
আছে তোরই ভিতর অতল সাগর
তার পাইলি না মরম।
তার নাই ফুলকিনারা শাস্ত্রধারা নিয়ম কী রকম।
রবীন্দ্রনাথও বলেন
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি তাই হেরি তায় সকল খানে।
অথবা —
ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দুনয়নে।
কিংবা —
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি,
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।
রুমীও বলেন
আমি দেখলাম, তিনি আমার অন্তরেই আছেন, আর কোথাও নাই।
লালনের —
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
সিন্ধি মরমী কবি সাচালও বলেন–
প্রিয়তম আমার হৃদয়েই আছেন, তিনি আমার দেহ-বাগের
কোকিল, আমি প্রিয়তমকে আমার হৃদয়ের মধ্যেই দেখেছি,
দিল-আলোকরা তিনি এসেছিলেন আমার চেতনার সীমার
ভেতরে।
আল্লাহ বলেন
মো কো কহ ঢুড়ো বন্দে, র্মৈ তো তেরে পাসর্মে।
সৈঁ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাস মে। (কবীর)
কলন্দর বলেন–
নহো মোল্লা, নহে ব্ৰহমন দুই কো ছোড় কর পূজা
হুকুম হৈ শাহ কলংরকা আনলক কহা তাজা।
মদন বলেন–
তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।
লতিফও বলেন —
আল্লাহ হচ্ছেন প্রেমের বশ। তাই তিনি বলেন,
তোমার হৃদয় কর আলিফের লীলাস্থল
তাহলেই বুঝবে তুমি কেতাবী গানের অসারতা।
জীবনকে দেখতে শেখো, তাহলে বুঝবে
আল্লাহর নামই যথেষ্ট। প্রিয়ের মিলন আকাঙ্ক্ষা
যার জেগেছে, সে কেবল প্রিয়তমের পাঠই পড়ে।
কিংবা–
প্রিয়তমের পথ অতি সরল ও প্রশস্ত।
কেবল কামনা-বাসনার কাটাই তাকে আকীর্ণ করেছে।
অথবা–
নামাজ রোজা ভালো বটে
কিন্তু প্রিয় মেলে অন্য বাটে।
হাফিজও বলেন —
ঢালো সুরা সখি সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়।
কবি সাচাল বলেন
পাপ-পুণ্যের পথে আল্লাহকে কেউ জানতে পায় না।
বেদিল বলেন —
পুথি পড়ে কী হবে; কেবল ফানার তত্ত্ব শেখো।
শাহ লতিফ বলেন
আমার চোখদুটো দেখে কেবল দেখে।
তারা দেখেছে প্রেমে এবং চিনেছে প্রেম
আর তাই ফিরে এসেছে আমার কাছে।
কিংবা
প্রিয়তম তুমি যখন আমার তখন পৃথিবী আনন্দে গেয়ে ওঠে
পথে পথে তৃণ-লতা-ফুল তোমাকে চুম্বন করে ধন্য হয়।
তোমাকে দেখে আমার সকল আশা মুহূর্তে মিটে যায়।
রবীন্দ্রনাথও বলেন–
তোমার আমার মিলন হবে বলে
এমন ফুল্ল শ্যামল ধরা…
তাদের কথায় ধাঁধা লাগে।
তোমার কথা আমি বুঝি,
আমার আকাশ তোমার বাতাস।
এই তো সবি সোজাসুজি।…
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।
উপরে আমরা দেখতে চেয়েছি, দুনিয়াব্যাপী সব মরমী সাধকের এক বোল এবং সাধনার লক্ষ্যও অভিন্ন; কেবল ভঙ্গিটি দেশ, কাল ও ব্যক্তিভেদে বিচিত্র। আমাদের বাউল গানে যতটা ব্যবহারিক জীবন ও সমাজ-চেতনা রয়েছে, সিন্ধি মরমী সাহিত্যে ততটা নেই। আবার বাউল গানে ছন্দোমাধুর্যের বিশেষ অভাব আছে, সুরের লালিত্য এবং বৈচিত্র্যও কম। কিন্তু শাহ লতিফের গান ও গাথা রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই ছন্দোবদ্ধ কবিতা। শাহ লতিফ সচেতন সুরকার ও ছন্দকুশল শিল্পী। তার অধিকাংশ দোহরা, কাফী ও গাথার সুর তাঁর সৃষ্টি। সিন্ধিরা আজো তার দেয়া সুরে তাঁর সৃষ্ট রাগ-রাগিণীতে যে কেবল তাঁর রচিত গানই গায় তা নয়: অন্যন্য গান এবং গাথায়ও তার সাধা সুর প্রয়োগ করে। তাঁর অনেক গান ক্ল্যাসিক্যাল ঢঙে গীত হয়। মরুভূ সিন্ধুর লু হাওয়া যখন সিন্ধিদের দেহমন তপ্ত ও অশান্ত করে তোলে, তখন শাহ লতিফের দোহরার গীতমূৰ্ছনা তাদের। দেহেমনে স্বস্তি-শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। কিংবা যখন জীবন-জীবিকার নানা যন্ত্রণায় তারা মুষড়ে পড়ে, তখনো শাহ লতিফের গানের অনবদ্য প্রাণ-জুড়ানো সুরে ও ভাব-রসে বিভোর হয়ে তারা স্নিগ্ধ প্রশান্তি লাভ করে। এক কথায়, শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিদের জীবনমরূর মরূদ্যান। তাই সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়, উৎসবে-পার্বণে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় তারা শাহ লতিফের শরণ নেয়। সে শরণ তার রুহের দোয়ার, তাঁর গানের-তার বাণীর। দু-শ বছর আগের শাহ লতিফ আজো সিন্ধিভাষীর হৃদয়-মনের একচ্ছত্র রাজা। তিনি তাদের প্রাণ জুড়ে বিরাজ করছেন, তাদের মন মননের দিশা দিচ্ছেন।
শিক্ষার হের-ফের
লেখাপড়া করলেই বা জানলেই লোক শিক্ষিত হয় না। কাজেই লেখাপড়া জানা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। অর্জিত বিদ্যার ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয় অংশ বোধ-বুদ্ধির আয়ত্তে এনে জীবনচর্চার অন্তর্গত করে নিতে না জানলে বা না নিলে মানুষ শিক্ষিত হয় না। এজন্যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক।