বহুকাল পরে তিনি ঘরে ফিরলেন। এদিকে মীর্যা মুঘল বেগের পরিবারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পীর-পরিবারের উপর পীড়ন করার ফলেই দুর্ভাগ্যের দুর্দিন দেখা দিয়েছে মনে করে অনুতপ্ত মীর্যা মুঘল বেগ লতিফের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলেন। এ কাহিনী ছোট ভিটাই (ভিটাইয়ের দুলামিয়া) নামে আজো চালু আছে।
এবার গৃহী সাধক লতিফ ইরানি সূফী কবিদের মতো পুরোনো লৌকিক প্রণয় গাথাগুলোকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মানুষ ও আল্লাহর প্রেমের রূপকে রূপান্তরিত করেন। এগুলোও রুচিমতো মানবিক প্রণয় কিংবা অধ্যাত্মপ্রেমের রূপক হিসেবে আস্বাদন করা যায়। এতে স্বদেশপ্রেম, সাহস প্রভৃতি ব্যবহারিক গুণের আলেখ্য আছে। এভাবে পুরোনো প্রণয় গাথাগুলোক তাঁর হাতে নতুন মহিমায় উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মুহনী মহিয়াল, শশীপুন্ন, হির ঝনঝা, মোমেল-রানু, লীলা-চানেসার, সোবথ দিয়া-বিজল, মা আরভি-মারুঙ্গ-উমর প্রভৃতি তাঁর অমর কীর্তি। কেউ কেউ বলেন, শাহ লতিফ ৩৬টি নাট্য-গাথার রচয়িতা।
১৮৬৬ সনে জার্মান পণ্ডিত Tremp-ই প্রথম শাহ লতিফের কাব্য-সগ্রহ বের করেন। পরের বছর বোম্বাই সরকারের শিক্ষা দফতর থেকেও একটি সংশোধিত ও বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সনে Dr.Surely তাঁর Shah Abdul Latif of Bhit Shah নামের গবেষণামূলক গ্রন্থে লতিফের জীবনকাহিনী ও তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। হায়দরাবাদের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শাহ লতিফের রচনার নির্ভরযোগ্য সিন্ধি সংস্করণ ও তার উর্দু তরজমা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়াও, পাকিস্তানের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ও বোম্বাই প্রদেশে শাহ লতিফ সম্বন্ধে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে এবং সে সূত্রে তাঁর রচনার কিছু কিছু অনুবাদও হচ্ছে।
শাহ লতিফ সাধনা ও কবিত্বের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই পেয়েছিলেন। পীরালি সূত্রে লোকসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঐতিহ্যও ছিল সুপ্রাচীন। তাই তিনি সহজেই জনগণকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন, আর নিজেও হয়ে উঠেছিলেন তাদের আপন মানুষ। ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা হিসাবেই চিরকাল মুখের বুলি সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে। সিন্ধি-ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহাসিক যুগে দেখতে পাচ্ছি, ধর্মের, দরবারের ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল সংস্কৃত, তারপরে মুসলমান আমলে দরবার ও সংস্কৃতির ভাষা হল ফারসি, ইংরেজ আমলে হল ইংরেজি। তাই দেশের আঞ্চলিক বুলিগুলো স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে বিকাশ লাভ করে শালীন সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হতে পায়নি। তবু এর মধ্যে গৌতমবুদ্ধ ও বর্ধমান মহাবীরের ধর্মপ্রচারের বাহন হয়ে পালি ও প্রাকৃত, রাজপুত রাজাদের প্রশাসনের মাধ্যমরূপে অবহট্ট, এবং মধ্যযুগের কলন্দর, রামানন্দ, কবীর, দাদু, রামদাস, রজব, নানক, চৈতন্য প্রমুখের মতপ্রচারের বাহন হয়ে আধুনিক সাহিত্যিক ভাষাগুলো গড়ে ওঠে। ধর্ম প্রচার ও রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক ভাষারূপে তুর্কী আমলে একবার এবং ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে আর একবার বাঙলা ভাষার বহুল চর্চা হওয়ার ফলেই বাঙলা অন্যান্য পাক-ভারতীয় আধুনিক ভাষাকে (রূপে ও সামর্থ্যে) অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু সিন্ধি ভাষা এ সৌভাগ্য থেকে অনেক কাল বঞ্চিত ছিলো। প্রধান কারণ, সিন্ধু ভারতের সীমান্ত-মুখের দেশ হওয়ায় চিরকাল বিদেশী আক্রমণের কবলে পড়েছে, স্বাধীন বিকাশের সুযোগ পায়নি। দারা, আলেকজান্ডার, মুহম্মদ বিন কাসিম, মুহম্মদ গজনভী, মুঘল, নাদির শাহ, আহমদ শাহ প্রভৃতির আক্রমণের কবলে যে সিন্ধু প্রাণে মরেনি, তাই তা যথেষ্ট। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রী.) পর কুলহুড় বংশীয় নূরমুহম্মদ-আধা স্বাধীনভাবে সিন্ধু শাসন করবার অধিকার পান। কুলহুড়রা ছিলেন সিন্ধিভাষী। দরবারি ভাষা ফারসি থাকা সত্ত্বেও এদের সময়েই সিন্ধি ভাষার বহুল চর্চা শুরু হয় এবং সাহিত্য সৃষ্টি হতে থাকে। অবশ্য পনেরো শতক থেকেই সিন্ধিরচনার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কুলহুড় বংশের পতনের পর তালপুর বংশীয়রা ১৮৪৩ সন পর্যন্ত সিন্ধুর শাসক ছিলেন। এরপর ইংরেজ শাসনে সিন্ধির কদর হ্রাস পায়।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময় শাহ লতিফের বয়স ছিল আঠারো। কাজেই শাহ লতিফের বাকি জীবন কুলহুড় শাসনাধীনেই কেটেছে। শাহ লতিফের সূফীমত তার সিন্ধি ভাষায় রচিত গানগাথার মাধ্যমেই প্রচার লাভ করে। তখনো এ ভাষা ও সাহিত্যে লোকবুলিও লোকসাহিত্যের স্তরে উত্তীর্ণ হয়নি। বিশেষ করে শাহ লতিফের উদ্দিষ্ট শ্ৰেতাও ছিল অশিক্ষিত জনগণ। শাহ লতিফ মুখে মুখেই তার গান ও গাথা রচনা করেন। (জনশুতি এই যে, লতিফ লিখে লিখেই তাঁর গান ও গাথা রচনা করেন। কিন্তু অহংকার বিলুপ্তির জন্যে তিনি নিজের হাতেই তার পুথিগুলো কিরার হ্রদের পানিতে ফেলে দেন।) গাইয়ে শিষ্যরা তা শ্রুতিস্মৃতিতে জিইয়ে রেখেছে এবং পুরুষপরম্পরায় তা মুখে মুখে চালু রয়েছে। অবশ্য শিক্ষিত লোকের পড়বার জন্যে আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে তার রচনাবলী লিপিবদ্ধ হয়। কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তাঁর রচনা অবিকৃতভাবে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। তবু ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে, শব্দের চয়ন ও বিন্যাস-সৌন্দর্যে শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিভাষায় অতুলনীয়। তাই আজো তিনি শ্রেষ্ঠ সিন্ধি কবি। তিনি একাধারে লোককবি, সাধক কবি এবং শালীন সাহিত্যের কবি-শিল্পী। এজন্যেই রসিক ও ভক্ত, পণ্ডিত ও মূর্খ, যোগী ও সূফী এবং হিন্দু ও মুসলমান সকলেরই তিনি প্রিয় কবি। আঙ্গিকের দিক দিয়ে সিন্ধি ভাষায় তাঁর বিশেষ দান ওয়াই-শ্রেণীর কবিতা। সোরথ, মা আরভি, আ-আরবি, দোথী, মা আয়ুরী হোসাইনী, সোহিনী, কোহিয়ারী (পাহাড়ী) প্রভৃতি সুরে শাহ লতিফের গান ও গাথা গীত হয়।