হায়দরাবাদ থেকে বাসে ভিটশাহ্ যাত্রা করলাম। পাকা ঋজু রাস্তা চলে গেছে লাহোর পেশোয়ারে। দু-ধারে সবুজের সমারোহ। মনে হচ্ছে, বাঙলা দেশেরই কোথাও শরতে ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলেছি। মনে হয় পানির স্পর্শে পাষাণ-প্রাণ অহল্যা জেগে উঠেছে। মরুতে সোনা ফলেছে। গম আর তূলা ক্ষেত। বাড়ন্ত ফলন্ত অবস্থা। দেখলে চোখ জুড়ায়।
সিন্ধু জেগেছে। তার মাটি জেগেছে, তার মানুষ জেগেছে। প্রাণের পরশ মাটির ফসল সে উল্লাস ব্যক্ত করছে নৃত্যের তালে তালে। আর মানুষের আশাপ্রদীপ্ত প্রাণে দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। মরু বালুকার বুকে যেমন জেগেছে জীবন-স্বপ্ন, তেমনি সিন্ধিরাও করেছে বৃহৎকে তাদের ধ্যানের বস্তু। দুটোই সম্ভব হয়েছে শুকুর ও গোলাম মোহাম্মদ বাঁধ প্রভৃতির মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার ফলে। প্রকৃতি-নিগৃহীত সিন্ধিরা এভাবে প্রকৃতিকে এনেছে বশে, আর তাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে বাস্তবায়নের পথে। এসবের আভাস পেয়েছি সাধক কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই-এর উরসের মেলায়। বসতি-বিরল সিন্ধুর জনসংখ্যা হচ্ছে মাত্র চল্লিশ লক্ষ।
দূরদূরান্তর থেকে দুইদিনব্যাপী মেলায় এসেছে প্রায় দু-লক্ষের মতো লোক। চল্লিশ লক্ষের মধ্যে দু-লক্ষের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য দেয় যে, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই সিন্ধিদের হৃদয়-রাজ্যের রাজা ও জাতীয় মানসের প্রতীক। তাই আজ ভিটাই-বার্ষিকী দূরদেশের উরস মাত্র নয়, বরং জাতীয় মহোৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে সিন্ধু নিজেকে প্রকাশ করছে। স্থির করেছে নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য। শাহ আবদুল লতিফের সাধনা ও বাণীর মাধ্যমে জাগছে তাদের জীবন-জিজ্ঞাসা। আর জীবনের দিশাও তারা খুঁজছে সেই আলোকে। আবদুল লতিফ ভিটাই ইতর-ভদ্র ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবারই প্রিয়। অশিক্ষিতরা তাঁর কাছে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির বাচ্ছা নিয়ে; আর শিক্ষিতেরা তার মধ্যে খোঁজে জাতীয় মানসের স্বরূপ। অশিক্ষিতের কাছে লতিফ ঐহিক জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা-সহায় আর অধ্যাত্ম জীবনের পীর এবং শিক্ষিতের চোখে তিনি জাতীয় মনন ও সংস্কৃতির প্রভিভূ। অশিক্ষিতেরা করে উস আর শিক্ষিতেরা করে স্মৃতিবার্ষিকী। এভাবেই শাহ লতিফ হয়েছে সিন্ধিদের আশা-ভরসা ও লক্ষ্যের অবলম্বন। এক কথায় লতিফ National hero, সবাই তাঁর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। দেখেশুনে মনে হয়, লতিফের সাধনা ও বাণী আদর্শ করেই সিন্ধু জেগেছে, সিন্ধু জাগছে।
এবার শাহ লতিফের পরিচয় দেব। মহৎ জীবনের উপর অলৌকিকতা আরোপ করা একটি মানবিক দুর্বলতা। শাহ লতিফ-চরিত্রও এই অলৌকিকতার প্রলেপ থেকে মুক্ত নয়। তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর সম্বন্ধে কয়েকটি অদ্ভুত কাহিনী চালু আছে। ভক্তজনের কল্পনাপ্রসূত এসব কাহিনী থেকে তথ্য ও সত্য উদ্ধার করা সহজ নয়। তাই আগে শাহ আবদুল লতিফের জীবনী লিখিত হয়নি। তবে যারা দশের উপরে বড় হন, তাঁদের জীবনে হয়তো কিছু অসামান্যতা থাকে। সে অসামান্যতাই ভক্তজনের চিত্তমুকুরে অলৌকিকতার রূপ ধরে প্রচার লাভ করে।
১৬৮৯ সনে হায়দরাবাদের হালাহাবেলী গ্রামের এক প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে শাহ লতিফের জন্ম। তাঁর পিতার নাম শাহ্ হাবীব। প্রপিতামহ শাহ আবদুল করিম কবি ছিলেন। পীরালিই পারিবারিক পেশা। মেধাবী লতিফ অল্প বয়সেই আরবি, ফারসি ও ইসলামে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
হালাহাবেলী অঞ্চলে এক তায়মুরী পরিবার ছিল চেঙ্গিস-তৈমুরের বংশধর এবং দিল্লীর বাদশাহর জ্ঞাতি বলে সমাজে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও আভিজাত্য ছিল। শাহ লতিফেরা ছিলেন তাদের পীর-পরিবার। একবার তায়মুরী পরিবারের প্রধান মীর্যা মুঘল বেগের কুমারী কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিরাময়ের জন্যে আল্লাহর নাম কালাম পড়ে দোয়া করবার জন্যে ডাক পড়ল পীর শাহ হাবীরের। তিনি কোনো কারণবশত যেতে পারলেন না, পাঠালেন কিশোর ছেলে লতিফকে। পীরের কাছে পর্দা নেই। কাজেই লতিফকে অন্দরে রোগীর শয্যাপাশে নেয়া হল। বয়োধর্মের গুণে লতিফ প্রথম দৃষ্টিতেই মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হলেন। এবং তার হাত ধরে আত্যন্তিক আবেগে তাকে প্রেম নিবেদন করলেন। বললেন, সৈয়দের হাতের ছোঁয়া লেগেছে যার আঙুলে, সাগর তরঙ্গের সাধ্য নেই তাকে ছিনিয়ে নেয়। দেশজ প্রথায় এটা যথার্থই পাণিগ্রহণ। পীর-পুত্রের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করা মীর্যা মুঘল বেগের পক্ষে কঠিন হল। কলঙ্কের ভয়ে তিনি এ কথা প্রকাশ করলেন না বটে, কিন্তু পীর-পরিবারের উপর নানাভাবে নিপীড়ন শুরু করলেন। ফলে শাহ্ হাবীব গাঁ ছেড়ে আত্মরক্ষা করলেন। এদিকে কিশোর লতিফ প্রণয়ে ব্যর্থতার আঘাতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘর ছাড়লেন এবং বিবাগী হয়ে, যোগী হয়ে সন্ন্যাসীদলে ভিড়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। এ সময়ে তিনি যোগশাস্ত্র ও সুফীমতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। কাবুল, কান্দাহার, হিংলাজ, যশশ্মীর, কচ্ছ, কাথিওয়ার, লাসবেলা, মাকরান প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করলে তিনি নানা ধর্মমত ও বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এ অভিজ্ঞতার প্রভাবে তিনি নতুন মানুষ হয়ে উঠলেন, নারী-প্রেম ভূমা-প্রেমে উন্নীত হল। ঐহিক কামনা পরমের সাধানায় রূপ পেল। তিনি হলেন যোগী সূফী এবং সাধক কবি। বিবাগী জীবনে তিনি স্বরচিত দোহরা গেয়ে বেড়াতেন। আমাদের পদাবলীর সঙ্গে দোহরার একদিকে মিল আছে; কেননা এগুলো মানবিক ও অধ্যাত্ম- এই উভয় প্রেমের গান হিসেবে উপভোগ করা চলে।