বাঙলা ভাষায়ও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে : এগুলো ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও সাধন সাহিত্য।
ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে :
নেয়াজ ও পরাণের (১৭ শতক) কায়দানি কেতাব, খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক) হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়নামা, শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের (১৬৬৪ খ্রী.) তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মাসায়েল, আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহ (১৮ শতক) নসিয়ত নামা, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক) সিফৎ-ই-ইমান, সৈয়দ নাসির উদ্দিনের (১৮ শতক) সিরাজ ছবিল, মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, বালক ফকীরের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, সৈয়দ নুরুদ্দীনের (১৮ শতক) দাকায়েকুল হেকায়েক রাহাতুল কুলুব, মুহাম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতু ফেকাহ, হায়াৎ মাহমুদের (১৮ শতক) হিতজ্ঞানবাণী, আফজল আলীর (১৮ শতক) নসিয়ত নামা প্রভৃতি।
খ. তত্ত্বসাহিত্যে পাই : হাজী মুহম্মদের (১৬ শতক) নূর জামাল, মুহম্মদ আকীলের মুসানামা, খোন্দকার নসরুল্লাহর মুসার সাওয়াল, শেখচাঁদের (১৬ শতক) শাহদৌলাপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের (১৬ শতক) শিহাবুদ্দিন নামা, আলী রজার (১৮ দশক) সিরাজকুলুব, আগম ও জ্ঞানসাগর; শেখসাদীর (১৭ শতক) গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফরনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের (১৮ শতক) আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, সৈয়দ নুরুদ্দীনের মুসার সওয়াল, বুরহানুল আরেফিন, অ-জানা কবির মুসার রায়বার, হোরান জরীপ (সম্ভবত পুরাণ জরীপ) মীর মুহম্মদ শফীর (১৭ শতক) নূর নামা, কাজী মনসুরের (১৮ শতক) সিনামা অজ্ঞাতনামা কবির মুসা পয়গাম্বরের কেচ্ছা, শেখ জেবের আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্যক্ত প্রভৃতি। গ. সাধনসাহিত্য : ভক্তিবাদে রয়েছে দ্বৈতরূপ–সাধন ও ভজন। সাধনস্তরে সূফী ও যোগতত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সাধন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য শেখ ফয়জুল্লহর (১৬ শতক) গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের (১৫৮৪-৬৮ খ্রী.) জ্ঞান প্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, আবদুল হাকিমের চারি মোকাম ভেদ শেখ চান্দের হর গৌরী সম্বাদ, মোহসিন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি। আর ভজন সংগীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীত, বাউল ও মুর্শিদী গান।
শাহ্ আবদুল লতিফ ভিটাই
করাচী থেকে ট্রেনে করে হায়দরাবাদ রওয়ানা হলাম ভিটশাহ উদ্দেশে। মরু সিন্ধুর বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুদিকে বসতি বিরল ও বসতিহীন প্রান্তর; এখানে ওখানে বাবলা গাছ, কাঁটা ঝোঁপ আর পাথুরে টিলা। প্রকৃতির এ রুক্ষতা ভাবিয়ে তোলে, বিস্মিতও করে। যেখানে সংগ্রাম সেখানেই বুঝি স্বাস্থ্য। নইলে প্রাচুর্যের দেশ বাঙলায় কেন জন ও জীব দুইই ক্ষুদ্রকায়। আর অনুর্বর অঞ্চলে মানুষে পশুতে কী পায় আর কী খায় যে সেখানে এরা আকারে বড় আর স্বাস্থ্যে সুষ্ঠু। ট্রেন চলেছে। একঘেয়ে দৃশ্য। তাই মন চলে গেছে সুদূর অতীতে। ইতিহাসের পাতা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এ মরুভূমিতে দেখা দিয়েছিল একদিন প্রাণ-বন্যা, উঠেছিল বিচিত্র জীবনের কলরোল। ময়েনজোদাড়োর বিস্ময়কর সংস্কৃতি-সভ্যতা সেই মুখর জীবনের প্রতীক। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা প্রাচীন মানুষের অক্ষয় কীর্তি। দেখতে পাচ্ছি দাহিরের পরাজয় ও লাঞ্ছনাম্লান মুখ, মুহম্মদ বিন কাসিমের বিজয়দীপ্ত চেহারা, দৃপ্ত পদক্ষেপ। মুসলিমের বিজয় কেতন। পরে আরো কত পরাক্রান্ত দাম্ভিক বিদেশীর উদ্ধত পদধ্বনি। তারপর এই বিগত শতকে তালপুর বংশীয়রা সিন্ধু শাসন করেছেন। ১৮৩১ সনে বৃটিশের নজর পড়ল সিন্ধুর ওপর। তালপুরেরা সে শ্যেনদৃষ্টির সামনে টিকতে পারল না। ১৮৪৩ সনে সিন্ধু পড়ল বৃটিশ খপ্পরে।
কতক্ষণ অতীতের ইতিহাসলোকে ছিলাম জানিনে, আবার যখন নিজের মধ্যে ফিরে এলাম, তখন দেখছি ট্রেন কোটরি স্টেশনে থেমেছে। কোটরি একটি ক্ষুদ্র শহর–সিন্ধুর আঞ্চলিক শাসন ও বাণিজ্য কেন্দ্র।
এক ঘণ্টার মধ্যে হায়দরাবাদ পৌঁছলাম। হায়দরাবাদ প্রাক্তন সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী, তখন আঞ্চলিক শাসনকেন্দ্র। বড় শহর। লোকসংখ্যা শুনলাম প্রায় তিন লক্ষের মতো। রাজধানীসুলভ সব প্রতিষ্ঠানই আছে। দু-তিনটে সিন্ধি ও উর্দু দৈনিক বের হয় এখান থেকে। আমরা সরকারি অতিথি। আমাদের দেখাশুনার ভার পড়েছে হায়দরাবাদের ইনফরমেশন বিভাগের উপর। ইনফরমেশন অফিসার ও তার দুই সহকর্মী জনাব হাজী আবদুর রহমান আর জনাব আলাড়ী দায়-সারানো সরকারি কাজ হিসেবে আমাদের ভার নেননি, বরং শ্রদ্ধেয় পারিবারিক অতিথি হিসেবেই বরণ করেছিলেন। তাঁদের সৌজন্য, আন্তরিকতা, যত্ন-আপ্যায়ন আমাদের অভিভূত করেছে। দু-দিন আমরা সেখানে ছিলাম। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে থাকতেন। হালিম সাব সুদ্ধ এ চারজন সিন্ধি ভদ্রলোকের আচরণ সুপ্রাচীন আরবি ঐতিহ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিল।
প্রাণের স্পর্শে প্রাণ জাগবেই। তা প্রেমে হোক, প্রীতিতে হোক কিংবা সৌজন্যে হোক। তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তায় আমরাও তাই তাঁদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম যে তারা সরকারি কর্মচারী, কর্তব্য করছেন মাত্র, তাই বিদায়কালে আত্মীয় বিচ্ছেদের বেদনা অনুভব করেছি।