অতএব, মানুষ বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসাকে পাথেয় করেই বাঁচে। তাই বিশ্বাস- ভরসা ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী থেকে আঘাত পেলে মানুষের জীবন বিষিয়ে ওঠে, বাঁচা অর্থহীন হয়ে পড়ে। পৃথিবী হয়ে ওঠে বাসের অযোগ্য। ম্লান হয়ে ওঠে সমাজ-সংসার। এই বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসার বন্ধনেই অনাত্মীয়-অপরিচিত হয় পরমাত্মীয়। তাই স্ত্রী বা স্বামীর মতো আপন আর
আবার গোড়ার কথায় ফিরে আসতে হয়। কেননা এমনি অবস্থায় কেবল দেহে-মনে সুস্থ লোকই বেপরওয়া হয়ে বাঁচতে পারে। এবং বেপরওয়া জীবনেই প্রাণধর্ম পায় তার স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। অতএব, যার জীবনে বিশ্বাস-সংস্কার ও সমাজের প্রভাব যত কম, সে তত বেশি মুক্ত মানুষ। অকৃত্রিম জীবন-চেতনা, অবিমিশ্র জীবন-সত্য লাভ কেবল সর্বপ্রকারের বন্ধনমুক্ত মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তার জন্যে চাই দেহ-মনের যৌবন। কেননা সুস্থ যুবক-যুবতীই কেবল বাঁচতে জানে বিরুদ্ধ পরিবেশে আর কেউ নয়।
আর সব হৃত-যৌবনের কান্নায় কাতর। এমনি এক হৃত-যৌবনের কান্না শুনি মোহিতলালের এক কবিতায় :
আমার সকল কামনা ফোটেনি এখনো
ফোটেনি গানের শাখে।
চৈত্র নিশীথে বসন্ত কাঁদে দ্বারে হেরি বৈশাখে ইত্যাদি।
আর সবার কাছে জীবনতত্ত্ব নানা বাহ্যরঙে রঙিন, খণ্ড-চেতনায় খণ্ডিত। তাই আজো তথ্যরূপী তত্ত্ব এত বিচিত্র ও বহুধা। জীবন-সত্যকে এভাবে কোনোদিন সমগ্র সত্তায় পাওয়া যাবে না। তাই মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণ থাকবে বিচিত্র, তার রহস্য থাকবে চিরআবৃত।
একটি আষাঢ়ে চিন্তা
মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশের মূলে যৌন সংযমের দান অনেকখানি। বলতে গেলে যৌন নিয়ন্ত্রণই সমাজ সংস্থার ভিত্তি। এই যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করা সম্ভব ও সহজ হয়েছিল।
এ উদ্দেশ্যেই অপ্রতিরোধ্য ও অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজন ও সৃষ্টিসম্ভব প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের ঘৃণা–সে কারণে লজ্জা-জাগানো আবশ্যিক হয়ে ওঠে।
দেহ-মনের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের জন্যেও এর প্রয়োজন ছিল। কেননা, যোগ-সাধনায় এই যৌন সংযমই মূল সাধ্য। পরবর্তীকালে যোগতত্ত্ববিদ বলেছেন, যদি স্বাস্থ্য, দীর্ঘজীবন ও কায়াসাধনায় সিদ্ধি পেতে চাও তাহলে রমণ করবে
মাসে এক বছরে বারো
আরো যত কমাইতে পারো।
আজকের দিনেও কামুকতা ঘৃণ্য এবং লাম্পট্যই মানুষের চরিত্রে মুখ্য দোষ বলে বিবেচিত। এটিরই রূপক রয়েছে শামীয় (Semetic) পুরাণে ও ধর্মগ্রন্থে।
আদম-হাওয়া ছিলেন স্বর্গে। তাদের লজ্জা ছিল না, ছিল না কোনো গ্লানি বা পাপবোধ। তাঁরা নারী-পুরুষ হলেও যৌন-সম্পর্ক তাদের ছিল না। যৌনতা ছিল তাদের অজ্ঞাত। যৌনবোধ তখনো তাঁদের অনুভবের বাইরে। এঁরা একে অপরের সাথীমাত্র। আদমের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গিনী হিসেবেই হাওয়ার সৃষ্টি–আদমের প্রতি জেহোভার প্রথম অনুগ্রহ তাঁর প্রথম উপহার। বোঝা যাচ্ছে, নারী সৃষ্টির পরিকল্পনা জেহোভার আদৌ ছিল না। আদমের আনন্দ সহচরীরূপেই হাওয়ার উদ্ভব এবং জেহোভার দ্বিতীয় চিন্তার দান।
স্বর্গে আদম-হাওয়া ছিলেন বন্ধ্যা, উলঙ্গ ও লজ্জাহীন। কেননা রতি-রমণ ছিল তাদের অজ্ঞাত। সর্পরূপী শয়তান গিয়ে প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ করল হাওয়াকে। উল্লেখ্য যে, সাপ কামবিষের ও প্রজনন শক্তির প্রতীক। শয়তানের সর্পবেশ ধারণ সে-কারণেই। সে খাওয়া নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল। এ জ্ঞান নিশ্চয়ই যৌনবোধ। কেননা এ ফল ভক্ষণের পর তাদের যে-বোধ জাগল তা দেহ-চেতনা। সে-কারণেই তারা বৃক্ষপত্রে আবৃত করলেন তাঁদের দেহের যৌনাবেগ জাগাতে সমর্থ তেমন স্থানগুলো।
রূপকের আবরণ উন্মোচন করলে বোঝা যায়, এই গল্পে আদি মানব-মানবীতে যৌনবোধের উদয়-রহস্য বিবৃত। কায়িক সান্নিধ্যে ও স্পর্শে যৌনবোধের দীক্ষা হল উভয়ের। তারপর চিত্ত স্থৈর্যের প্রয়োজনে তারা দেহে দেন আবরণ। এই সচেতন সংযম-প্রয়াসই অভ্যস্ত লজ্জা ও সংকোচের রূপ নেয়। জীবজগতে নারীই রজস্বলা হয় সৃষ্টির প্রয়োজনে। কাজেই যৌনাবেগ প্রাকৃতিক নিয়মেই অপ্রতিরোধ্য হয় নারীতে। এজন্যেই হাওয়াই হলেন কামের প্রথম শিকার-কামবিমোহিতা। সেই থেকে নারী দোযখের দ্বার।
যৌনবোধে জাগ্রত নর-নারীকে নবাবিষ্কৃত সুখ-রহস্য ও নবলব্ধ অনুভূতি আকুল করেছিল। সুখ-উল্লাসে তারা তখন আত্মহারা। যৌনতায় নিমগ্ন মুগ্ধ মানব-মানবীর এই অসংযত কামচর্চা জেহোভা সহ্য করেননি। অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত আদি মানব-মানবী বিক্ষিপ্ত হলেন মর্তে। স্বর্গচ্যুত নর-নারী হলেন সৃষ্টিশীল। রমণ ও প্রজননই ছিল তাঁদের অবশিষ্ট জীবনের ব্রত ও কর্তব্য। অতএব তাদের অপরাধ যৌনবোধ আর পরিণাম হচ্ছে মর্তে বাস, রমণ ও প্রজনন। নইলে তারা চিরকাল থাকতেন স্বর্গে এবং থাকতেন বন্ধ্যা ও লজ্জাহীন এবং হতেন অমর। কাজেই স্বর্গ ও মর্ত্যে পার্থক্য যৌনবোধহীনতা ও যৌনতা। স্বর্গ আনন্দ ও আরামের এবং অজরামরতার, মর্ত্য দুঃখ ও যন্ত্রণার এবং জরামৃত্যুর। অতএব, যৌনবোধহীনতাই স্বর্গ-সুখ আর যৌনতাই দুর্ভোগের আকর। যৌনতা তাই ঘৃণার ও লজ্জার। কাম-বিমুক্তিই ব্রহ্মচর্য ও বৈরাগ্য তথা পবিত্রতা, চিত্তশুদ্ধি ও অধ্যাত্মসিদ্ধির সোপান। যে-যৌনতার কারণে আদি মানব-মানবীর স্বর্গচ্যুতি, মর্তে বাস ও মরণশীলতা এবং যে পাপের দুর্ভোগ কেয়ামত অবধি তাঁদের সন্তানদেরও পোহাতে হবে, সে-যৌনতা ঘৃণ্য না হয়ে পারে না। তাই শামীয় ধারণায় লাম্পট্য ও অসতীত্বই সবচেয়ে বড় পাপ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।