প্রবলপক্ষ তথা শক্তিমান যদিবা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসতে সাহস পায়, দুর্বলপক্ষ আত্মবিলয়ের আশঙ্কায় পিছিয়ে যায়। সে আত্মসংকোচনে ও আত্মগোপনেই খোঁজে স্বস্তি ও নিরাপত্তা। হীনবল শাসিত হিন্দুরও এসেছিল এই স্বাভাবিক আত্মসংশয়। হিন্দুর এই বিকৃতবুদ্ধি ও অসুস্থ মন শাসকের ধর্মে দীক্ষিত জ্ঞাতিদের প্রতিও বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল। অপরদিকে দেশজ মুসলমানরাও বিস্মৃতগোত্র ও শাসকদের জ্ঞতিত্বকামী হয়ে বিধর্মীর প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করাই স্বাতন্ত্র ও স্বধর্ম রক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় বলে জানল। আত্মরতি চিরকালই পরপ্রীতির পরিপন্থী। বিধর্মবিদ্বেষের জন্যে স্বধর্মনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন হয় না। এটি জীবনের একটি সাধারণ সংস্কারে পরিণতি পায় বলে বিশ্বাসের মতোই দৃঢ়মূল সংস্কার অধার্মিকের মনেও এ বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখে। কাজেই প্রাজ্ঞ ধার্মিকের মনে যদিবা কিছু সহিষ্ণুতা থাকে, আচারনিষ্ঠ ধার্মিক ও অধার্মিকের তাও থাকে না।
কাজেই এই স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও স্বধর্মপ্রীতিই তৃতীয়পক্ষ ব্রিটিশের শাসনকালে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক করে তিক্ততর এবং হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে করে তীব্রতর। পূর্ব গ্লানির স্মৃতিতে বিক্ষুব্ধ হিন্দুরা বুঝল না যাকে এড়ানো-সরানো যাবে না, যার সঙ্গে জীবন-জীবিকা একসঙ্গে গ্রথিত; তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করা, তাকে ঘা দেয়া আত্মপীড়নেরই নামান্তর। বিকৃতবুদ্ধি ও অসুস্থ মনের প্রভাবে হিন্দুরা ইংরেজ শাসনের দু-শ বছর ধরে এ আত্মঘাতী চিন্তায় ও আচরণে উৎসাহবোধ করেছে, পেয়েছে ছদ্ম আত্মোন্নয়নের প্রচুর আত্মপ্রসাদ। কার্যত মুসলমানের ক্ষতি করার সামর্থ্য ছিল তাদের সামান্যই, কিন্তু কথায় ও আচরণে লাঞ্ছিত করে মুসলমানদেরকে বিক্ষুব্ধ শত্ন করে তুলল তারা। কে না দেখল, হিন্দুর পক্ষে ভালো হয়নি এর ফল!
শক্তি যার আছে, সে দাপট দেখাবে; সে দাপটের ঘা কোথায় কখন কার গায়ে লাগছে, কেমন করে লাগছে, আর কী পরিমাণ মানস ও ব্যবহারিক ক্ষতি করছে, তা অনেক সময়ে অনেক ক্ষেত্রে থেকে যায় শক্তিমানের অগোচরে। ফলে যে আঘাত হানে সে স্মরণ করতে পারে না বটে, কিন্তু যে পায় সে ভোলে না। এ তত্ত্ব ব্রিটিশ আমলের মুসলমান সম্পর্কে খাঁটি তথ্য ও সত্য।
মুসলমান ছিল শাসক। আর হিন্দু ছিল শাসিত। তাই হিন্দুর মনে ছিল বেদনা ও ক্ষোভ। আর উত্তম্মন্য মুসলিম চিত্তে হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না বরং বিধর্মী বলে ছিল তাচ্ছিল্য। আবার শেষের দিকে মারাঠা ও শিখদের প্রতি উত্তরভারতীয় মুসলিম-মনে বিদ্বেষ-বিরূপতা জাগার কারণ ঘটেছিল। তখন সেখানে মুসলমান শাসিত এবং হিন্দু-শিখ শাসক। কিন্তু আমাদের বাঙলাদেশে সে-প্রতিবেশ ছিল অনুপস্থিত। পরে মুসলমানের সর্বনাশ ঘটে ব্রিটিশের হাতে। তাই ব্রিটিশ ভাগানোর লক্ষ্যে মুসলমানরা হাত মিলাতে চেয়েছিল হিন্দুর সঙ্গে ওহাবী-সিপাহী-কংগ্রেস আন্দোলনে। বৃত্তি বেশাত ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান এগিয়ে যাওয়া হিন্দুর কাছে অর্থ-বিত্ত হারিয়ে উনিশ শতকের শেষপাদ থেকে হারানো ধন, বৃত্তি ও চাকরি ফিরে পাবার সাধনায় যত্নবান হয়। তখন তাদের ব্রিটিশ-বিদ্বেষ হিন্দু-বিদ্বেষের রূপ নেয়। জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে তখন তারা প্রতিপক্ষ পেল হিন্দুকে। হিন্দুরা আগেই মুসলিমদের নানাভাবে ঘা দিয়ে বিরূপ করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সন অবধি এবং তার পরেও তার জের স্বরূপ দুপক্ষের দ্বন্দ্বের তীব্রতা ও কৌৎসিত্য সবাই দেখছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর–যদিও তার আগের মতো নীতি ও আদর্শবিরোধী, তবু বাস্তব বুদ্ধি ও শেয়বোধের প্রেরণায় গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঘোষণা করলেন : হিন্দু ও মুসলমান আর ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, সম-নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় জাতি পাকিস্তানী নামেই হবে পরিচিত।
ভারতও ঘোষণা করল নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু যেমন বিকৃত বুদ্ধি ও অসুস্থমনের প্রভাবে পড়ে হিন্দুয়ানির মোহ ও মহিমা প্রচারে উৎসাহী তেমনি কিছুসংখ্যক মুসলমানও ধর্মীয় জাতীয়তা, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রহণে-সৃজনে যত্নবান। ভারতে হিন্দিকে করছে সংস্কৃত-ঘেঁঘা আর পাকিস্তানে উর্দু হচ্ছে প্রায়-ফারসি। উভয় রাষ্ট্রেই এভাবে ব্যর্থ হয়েছে দেশনেতা ও রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় ও আবেদন। ফলে জাতীয় জীবনে স্বস্তি ও কল্যাণ আসেনি। গড়ে উঠতে পারেনি স্বস্থ ও সুস্থ জাতি। সফল হল না দেশনেতার আনন্দিত স্বপ্ন। ইংরেজ আমলের সে-আধি এখনো চেপে বসে আছে পাক-ভারতের মানুষের মনে-মগজে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের পাঠ্যপুস্তক ও বেতার হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর মহিমা কীর্তনে প্রযুক্ত। যাকে নিয়ে ঘর করতে হবে তার মন ভাঙলে কেবল যে ঘরের শান্তি নষ্ট হয় তা নয়, বিপদকালে সাহায্য সহানুভূতিও মেলে না। ঘরের শত্রুর মতো ক্ষতিকর শত্রু নেই। কেননা তাকে ঠেকানো যায় না। এ যুগে প্রথম মহাযুদ্ধ কালে জার্মানির ইহুদির ভূমিকা স্মর্তব্য। খ্রীস্টান জার্মানের অবজ্ঞা ও বিদ্বেষই জার্মান ইহুদিদের স্বদেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন করে তুলেছিল।
সংখ্যালঘুর প্রতি অন্যায় ও সংকীর্ণচিত্ততার পরিণাম হিন্দুদের পক্ষে শুভ হয়নি এবং স্বাধীন দেশের সংখ্যাগুরু নাগরিক হয়েও তারা তা ত্যাগ করেনি; এখনো দাঙ্গা বাধায়, অসহায়কে হত্যা করে। স্বাধীন দেশের সংখ্যাগুরু নাগরিক হয়ে সংখ্যালঘুর ধর্ম-সংস্কৃতির প্রভাবে পড়ার ভীতি জিইয়ে রাখা, আর সে-ভয়ে দিশাহারা হয়ে সামাল সামাল রব তোলা, দুর্বল সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যর্থ প্রয়াসে উদ্যোগী হওয়া, তার প্রতি সমকক্ষের হিংসা পোষণ করা প্রভৃতি বিকৃতবুদ্ধির, অসুস্থ মনের ও নিজের প্রতি আস্থাহীনতার পরিচায়ক।