কোনো কোনো রাষ্ট্র যেমন ধর্মীয় ঐক্য, ভাষার ঐক্য, রাজনীতিক মতবাদের ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য কিংবা ভৌগোলিক ঐক্যের নামে জন-সংহতি রক্ষণে ও গণ-বিদ্রোহ ঠেকাতে ব্যস্ত; তেমনি কোথাও আবার আর্থিক, ভৌগোলিক কিংবা গোত্রীয় স্বাতন্ত্রের নামে বা মতবাদের অনৈক্যের অজুহাতে একরাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গড়ে উঠছে।
উভয়ক্ষেত্রেই বিবেকহীন বড় শক্তিগুলো নির্লজ্জভাবে–এমনকি U NO-ও–নিজেদের স্বার্থানুসারে পরস্পর বিপরীত যুক্তিপ্রয়োগে কখনো সমর্থন, কখনো বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য, জার্মানি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি ভাঙতে যেমন তারা উৎসাহী ছিল, কঙ্গো-কাশ্মীর-বায়াফ্রা কিংবা নাগাভূমের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে তারা তেমনি কুণ্ঠিত। কিংবা তিব্বত-সাবাহ-বর্ণিও-সাইপ্রাস ব্যাপারে তাদের অন্যনীতি। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া কিংবা আরব-ইসরাইল সমস্যা সম্পর্কে তারা দার্শনিক।
রাজনীতিক খেল ও আর্থনীতিক চাল গোপন রেখে তারা দেশ বা রাষ্ট্র ভাঙাগড়ার ব্যাপারে তিনটে আদর্শের স্লোগান আওড়ায়–সাংস্কৃতিক ঐক্য বা স্বাতন্ত্র, অভিন্ন বা ভিন্ন জাতীয়তা এবং মতবাদের ঐক্য বা পার্থক্য। স্বাৰ্থিক গরজে কখনো ঐক্যের কথা বলে তারা মিলন ঘটায়, কখনোবা স্বাতন্ত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে। সংহতি ও বিচ্ছেদ দুটোই তাদের সমান প্রিয়। এবং প্রয়োজনমতো প্রয়োগে তারা রীতিমতো সব্যসাচী।
ম্যাকিয়াভেলীই এ যুগের রাষ্ট্রপতি ও দেশনায়কদের গুরু। ছলনা, প্রতারণা ও বাকচাতুরীই তাদের পুঁজিশক্তির উৎস ও ভিত্তি এবং নীতি ও অস্ত্র। এই নীতি ও অস্ত্র প্রয়োগে তাদের আপন পর, ঘর-বাহির ভেদ নেই। এই শাস্ত্র ও শস্ত্রের ব্যবহারে তাদের সমদর্শিতা অতুল্য। নতুন ও পুরোনো, ছোট ও বড় সব রাষ্ট্রেরই একরূপ।
.
০৩.
সংস্কৃতিতেও থাকে স্থান-কাল-পাত্রভেদ। সংস্কৃতি তাই কোনো রাষ্ট্রভুক্ত মানুষের ব্যক্তিক বা সামষ্টিক জীবনে অবিমিশ্র ও অভিন্ন হতে পারে না। কেননা ভৌগোলিক আবহাওয়া, জীবিকা, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, ধর্মমত, গোত্রীয় সংস্কার, ভাষিক প্রভাব, নৈতিক চেতনা, আচারিক প্রথা এবং উন্নততর বিদেশী ভাব-চিন্তা-আচার প্রভৃতির প্রত্যেকটির প্রভাবে রূপ পায় সংস্কৃতি। এজন্যেই একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও জার্মান-ফরাসি-ইংরেজের কিংবা আরব-ইরান-তুরস্কের সংস্কৃতি এক নয়, জাতীয়তাও নয় অভিন্ন।
গোত্রীয় ঐক্য বা নৃতাত্ত্বিক অভিন্নতাও এক সংস্কৃতি কিংবা এক জাতি গড়ে তোলে না– যেমন আর্য, সামীয় অথবা মঙ্গোলীয় মাত্রই এক জাতি ও এক সংস্কৃতিভুক্ত থাকেনি। আবার গোত্র, ভাষা, দেশ, ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি অভিন্ন হলেও এক সংস্কৃতি ও এক জাতি থাকে না–শিক্ষা সম্পদ, মত, আদর্শ ও স্বার্থভেদে সংস্কৃতি ও জাতি-চেতনায় স্বাতন্ত্র্য আসে–যেমন আরব রাষ্ট্রগুলো, যেমন কোরিয়া, জার্মানি ও ভিয়েতনাম। বস্তুত জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা আধুনিক উপসর্গ এবং তাই কৃত্রিম। রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার রূপেই এ দুটোর উদ্ভব, প্রসার ও স্থিতি এবং রাষ্ট্রগঠন ও রক্ষণকর্মেই কেবল এগুলো প্রযুক্ত। তা ছাড়া আজকের বিশ্বে ও-দুটোর আর কোনো উপযোগ নেই। প্রাগ্রসর বিবেকবান মানবকল্যাণকামী মানুষ যখন আন্তর্জাতিকতায় ও বিশ্বমানবতাবোধের স্বপ্নে আনন্দিত ও আশ্বস্ত, তখন এ দুটো আদর্শ প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর। তা ছাড়া রাষ্ট্র গঠন ও রক্ষণ ব্যাপারে জাতীয়তা ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতাও যে কেজো নয়– হৃতউপযোগ, তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আসলে সমস্বার্থের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র আর সমস্বার্থের স্বীকৃতিতে সহযোগিতায় ও সমদর্শিতায় টিকে থাকবে রাষ্ট্র। এর থেকে দৃঢ় ঐক্যসূত্র, এর থেকে বড় বন্ধন দুনিয়াতে কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। পরিবারে-গোত্রে সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্রই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে স্বার্থ। এজন্যেই দস্যু-তস্করের মতো দুশ্চরিত্র লোকও সমস্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। এরা দায়িত্ব-চেতনা, কর্তব্য-বুদ্ধি, সততা, আনুগত্য ও পারস্পরিক আস্থার প্রমূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রচলিত অর্থে অমানুষ এই দস্যু-তস্করের চরিত্রে এক অর্থে সুনাগরিকের সবগুণই বর্তমান। তাঁদের স্বাদল্য, কমরেডীভাব ও নীতিনিষ্ঠা তথা অঙ্গীকারনিষ্ঠতা অনুকরণীয়। মূলত স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে সৌজন্য ও সহৃদয়তার মিশ্রণ ঘটিয়ে, পরিবারে ও সমাজে পারস্পরিক ব্যবহারে প্রীতির মাধুর্য ও শোভনতার লাবণ্য দান করেই সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়েছে মানুষ। এরই নাম ন্যায়-নীতি-আদর্শ তথা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতা। অতএব সমস্বার্থের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান, সহযোগিতা ও সমদর্শিতাই এ যুগে রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষের ঐক্যের ও সংহতির একমাত্র সূত্র। ঠকাঠকিতে বাপ ভাইয়ের সঙ্গেও ঠোকাঠুকি অনিবার্য।
ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাস
ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাস
এ বছর দেখছি কোথাও কোথাও পলাশী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য বোধ হয় পরাধীনতার গ্লানি স্মরণ করে স্বাধীনতা ও স্বাজাত্যের মহিমা কীর্তন করা। ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টি আবেগে আচ্ছন্ন হওয়া অবাঞ্ছিত। নিরপেক্ষ বিচারেই ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কেননা তেমন শিক্ষাই কেবল ব্যক্তিক কিংবা জাতিক জীবনে ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব।