.
৪.
যামিনী রায় ঘরেই ছিলেন, তাকে ছবি আঁকা শিখতে হয়েছে বটে কিন্তু ঘরে ফেরার সাধনা করতে হয়নি। বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য আপনিই সেধে এসে তার তুলিতে ধরা দিয়েছে। কোনো গুরু এবং প্রতিষ্ঠানের আশীর্বাদ অর্জন করার বহু আগে কলালক্ষ্মী আদর করে এই দরিদ্র এবং অভিভূত ভক্তের হাতে গোপন অমৃত ভাণ্ডারের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছিলেন।
যামিনী রায় সম্পর্কে পেছনের কথা বলা প্রয়োজন। তৎকালীন গ্রামীণ বা শহুরে মধ্যবিত্তদের কেউ ছিলেন না এই যামিনী রায়। চিত্রকলা কিংবা অন্যান্য বিষয়ে যে নবীন ভাবধারার জোয়ার শহর কলকাতায় খলখল ছলছল বেগে প্রবাহিত হচ্ছিল আর্ট স্কুলে আসার পূর্ব পর্যন্ত তা তাকে স্পর্শও করতে পারেনি। ভক্তিমান এবং নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব সাহিত্যরসিকের পুত্র, সুতরাং ভক্তিই তার ধ্যান এবং ভক্তিই জ্ঞান হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। দেশের যে সকল কুমোর পুরুষ-পরম্পরা ঠাকুর দেবতার মূর্তি গড়ত, পুতুল বানাতো, পট আঁকত এবং জীবিকার তাগিদে এসব যারা বাংলাদেশের হাটে হাটে মেলায় মেলায় ফেরি করে বেড়াতো তাদের কাছেই প্রথম যামিনী রায়ের হাতে খড়ি। যদি কলকাতা শহরে একটা আর্ট স্কুল জন্ম না নিত, একটা শিল্প আন্দোলন মধ্যবিত্ত সচেতন বাঙালি মানসে সুবর্ণ তরঙ্গ না তুলত কে জানে হয়তো উত্তরকালে উক্ত যামিনী রায়ও একজন দক্ষ পট আঁকিয়ে এবং পুতুল গড়িয়ে হিসেবে ধর্মপ্রাণ হিন্দু মহিলার মনে ভক্তি এবং শিশুদের মধ্যে আচমকা বিস্ময় বোধ জাগিয়ে নামহারা পটুয়াদের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন।
বৈষ্ণব সাহিত্যের ঢলঢল লাবণীস্রোতে তো সঞ্চিতই ছিল তার মানসপট। আর্টস্কুলের শিক্ষা তাতে একটা স্নিগ্ধ তরঙ্গ জাগিয়ে দিল। বাংলার কুমোরের হাতে গড়া পুতুলেরা, কালীঘাটের ভাসাভাসা পটলচেরা চোখের অচল পটেরা যামিনী রায়ের হাতের জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায় নতুন প্রাণ পেয়ে বহু যুগ আগের ঘুম ভেঙে হঠাৎ করে জেগে উঠল যেন । যামিনী রায়ের আঁকা এ সকল ছবি দর্শক দেখামাত্রই চিনে নিল। পুলকিত বিস্ময়বোধের তাড়নায় কলারসিকের মনে একটা আশ্চর্যান্বিত জিজ্ঞাসা গুনগুনিয়ে উঠল: আরে এ তো আমাদের জিনিস, এই যে নারী তার অনুপম দেহ বল্লরী, পূর্ণিমা চাঁদের আকৃতির মুখমণ্ডল সে তো প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালে, এমন রসঘন নিবিড় গভীর চোখের দৃষ্টি, তার আলোকেই তো আমাদের সমাজ-সংসার আলোকিত। এমন নিটোল সুকুমার শোভনশালীন গড়ন ভঙ্গি, আর এত স্নিগ্ধ, এত নম্র যেন দলে দলে ব্রজবালারা কেলিকলা লীলারসের বেশভূষা ছেড়ে আমাদের সংসার-সীমান্তে কন্যা জায়া ভগিনী হয়ে আটপৌরে বসনে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যে-ই আঁকুক এ সকল ছবি; যে ঘনীভূত আবেগে বৈষ্ণব কবিরা গঠন করেছেন অতীতে পদাবলীর শরীর; সেই অচঞ্চল আবেগ, সেই অচলা ভক্তি নতুন ব্যঞ্জনায় মর্মরিত হয়ে উঠেছে এসকল ছবিতে। কে আঁকল, কে সেই আমাদের অতিশয় আপনার জন চিত্রকর।
রাতারাতি বাংলাদেশে বাংলাদেশের নিজস্ব চিত্রকর হিসেবে, বাংলার গহন সৌন্দর্যের রূপকার হিসেবে যামিনী রায় পরিচিতি লাভ করলেন। খ্যাতির ঢেউ দেশ পেরিয়ে বিদেশেও একটুখানি হাওয়া সৃজন করল। ধীমান কলাবিদ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী যামিনী রায়কে নিয়ে বিলেতের ‘টাইমস’ পত্রিকায় একটি মনস্বিতা সম্পন্ন রচনা প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানত শাহেদ সোহ্রাওয়ার্দীর দূতিয়ালীতেই যামিনী রায়ের বৈদেশিক খ্যাতি। আমাদের এ রচনার নায়ক শেখ সুলতানের শিল্পী জীবনের সূচনা সম্পর্কে আলোকপাত করার বেলায় আরো একবার আমাদেরকে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর নাম উচ্চারণ করতে হবে।
যামিনী রায় দেশীয় রীতিতে ঐতিহ্যনির্ভর মনোমুগ্ধকর অঙ্কনশৈলীর উদ্ভাবক এবং বাংলার একান্ত ঘরোয়া চিত্রশিল্পী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকে বোধকরি জানেন না, একসময়ে ক্লাসিক প্যাটার্নে অনেক ছবি তিনি এঁকেছিলেন। ইউরোপীয় চিত্রকরের আদর্শে অঙ্কিত এসকল চিত্র আজকাল কোথায় কি হালে আছে সম্ভবত কেউ বলতে পারবেন না। ছবি হিসেবে এগুলো একেবারে উৎকর্ষ বিবর্জিত ছিল একথাও বলা চলে না। তথাপি সে পথে শিল্পীর যাওয়া হয়নি। এটা শিল্পী যামিনী রায়ের জন্য ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে তা আজ অনুমান এবং বিতর্কের বিষয়। মোটকথা সে সময়ে দেশের মানুষ যামিনী রায়ের ছবির যে বিশেষ ভঙ্গিটি এবং যে বিশেষ অন্তরাবেগটির সহজ দৃষ্টিতে প্রশংসা করত, দেশীয়ানার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারত অনায়াসে, অনবরত যামিনী রায়কে সেই ছবিই এঁকে যেতে হয়েছে।
তুলির স্বচ্ছন্দ টানে টানাটানা ভাসাভাসা চোখ, চোখের ভেতর থেকে প্রকাশমান দিঘির বুকের নিথর কালো গভীর জলের অতল প্রশান্তি, মুখে মাখানো এমন একটা সহজ সারল্য, এমন একটা সহজিয়া আবেগ যে দর্শনমাত্রই মনে একটা প্রীতির ভাব ঢেউ খেলে যায়; এই সহজ গভীর ভাবের শিল্পী যামিনী রায়। একজন শিল্পী অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রকাশভঙ্গির যে একটা সহজতা, অনায়াসপনা অর্জন করে, এটা সে সহজতা নয়। এই সহজতা জলের মতো সরল, ঐতিহ্যের ভেতর থেকে সংস্কৃতির মর্মমধুর ভাণ্ডার থেকে বালক বয়সেই মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি তা মাতৃস্তন্যের মতো পান করেছিলেন। তারপরেও কিন্তু গভীর সাধনার আশীর্বাদ ছাড়া কেউ তা অর্জন করতে পারে না। তবে এই সাধনার ধারাটা যত বেশি সচঞ্চল মনোবৃত্তির অনবচ্ছিন্ন অন্তরাল প্রক্রিয়া বাইরে তার অভিঘাত বড় বেশি পরিদৃশ্যমান নয়। কোনো কোনো ওস্তাদ ঘরানার ছোট ছোট ছেলেরা যেমন গলা খেলিয়ে দুরূহ রাগ-রাগিনীর স্বরূপ ফুটিয়ে তুলে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয় সে রকম আর কি। সেখানেও একটা শিক্ষার প্রশ্ন থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থী তা অজান্তে বিনাশ্রমে বিনাযত্নে পরিবেশের কাছ থেকে অর্জন করে ফেলে। যামিনী রায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যাই আঁকুন না কেন তার ছবিতে একটা বাৎসল্য রসের আভাস বড় বেশি ফুটে ওঠে। কতিপয় পরিচিত অভিব্যক্তির বাইরে, অন্য কোনো ভঙ্গিতে, অন্য কোনো রসমূর্তিতে যামিনী রায়কে বড় একটা দেখা যায় না। তার শিল্পী জীবনের কোনো বাঁক, কোনো মোড়, কোনো পরিবর্তন, কোনো রূপান্তর নেই যেন। আপনাকে আপনি অতিক্রম করে যাওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষা তাকে কোনোদিন পেয়ে বসেনি। সুন্দর নিশ্চল বস্তুঘনতার জগৎ থেকে আকাশমণ্ডল কিংবা চলমান জগৎ প্রপঞ্চ অভিমুখে অভিযাত্রা নয়, অভিসারের আকাঙ্ক্ষাও তাকে তাড়িত করেনি। সুন্দর বদন, পেলব সুকুমার শরীর এবং প্রাণ লাবণ্যের রূপকার যামিনী রায়। যামিনী রায়ের হাতে বাংলার পুতুল, কালীঘাটের পট এবং আরো নানা শিল্প ঐতিহ্য নবীন জীবন লাভ করেছে।