সেই সময়টার কথাও বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। সবেমাত্র চিত্রকলা ব্লকের মাধ্যমে মুদ্রিত করে পত্র-পত্রিকায় ছেপে সাধারণের গোচরে আনার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে এদেশে। গোটা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লেগেছে। সর্বক্ষেত্রে জাতীয় ভাবধারার একটা দুর্বার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চাহিদা: জাতীয় সাহিত্য চাই, জাতীয় বিজ্ঞান চাই, জাতীয় শিল্প, জাতীয় বাণিজ্য চাই। ভারতের উঠতি বুর্জোয়া সর্বক্ষেত্রে নিজের অধিকার প্রসারিত করার জন্য মারি কি মরি পণ করে উঠে পড়ে লেগেছে। এই সময়ে অবনীন্দ্রনাথ চিত্রকলার একটা নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি করলেন। তা সর্বাংশেও যেমন ভারতীয় নয়, তেমনি সর্ব অবয়বে ইউরোপের অন্ধ অনুকরণও নয়। দুয়ের সংশ্লেষে হয়ে উঠল তৃতীয় বস্তু। অসাধারণ মৌলিকত্বসম্পন্ন ও সকল চিত্রকর্ম দেশের আলোকিত অংশের মন কেড়ে নিল । বিদেশীরাও প্রশংসা করল। অবনীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় শিল্পের জনক এবং ভারতের আত্মার অমর উদ্বোধক পুরোহিত হিসেবে আখ্যাত হলেন। কিন্তু কোন ভারত? যে ভারতে যক্ষ দয়িতার বিরহে একাকী অমোচন করে, যে ভারতে মোগল সম্রাট শাজাহানের ধ্যাননেত্রে তাজমহলের মর্মর সমাধিতলে শয়ান মমতাজ বেগমের মতো সুন্দর মৃত্যুস্বপন ঘনিয়ে আসে। অতীত ইতিহাস থেকে সন্ধান করে যে রীতি ধ্যানে, সাধনায় বের করে আনলেন; গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা অতীত রোমন্থনের মধ্যেই সীমায়িত রাখলেন। অতীত তার সামনে এমন কুহক জাল মেলে ধরেছিল যে তার গণ্ডি ভেদ করে বর্তমানের পথে পদচারণা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। চলমান জীবনের কোনো ছবি আঁকলেও অতীতের সেই সুন্দর কুয়াশা এসে বর্তমানের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মগুলো ভারতের চিত্রকলার আকাশে উজ্জ্বল অনুপম বরণবিশিষ্ট ইন্দ্রধনুর মহিমা নিয়ে জেগে থাকবে, একথা সত্যি। কিন্তু সেগুলো বাস্তবের কেউ নয়। হালকা মনোরম পুঞ্জ-পুঞ্জ রঙের প্রলেপে সৃষ্ট অর্ধেক শরীর অর্ধেক ছায়া মাত্র। শুধু অকাশে সঞ্চরণ করে, মেরুদণ্ড সোজা করে স্মৃতি স্বপ্নভারে ভারাতুর এসকল ফিগার মাটিতে দাঁড়াতে পারবে না।
তার এই সীমানা শিল্পী স্বয়ং জানতেন। জানতেন এই যে ফাঁক রয়ে গেল তা তিনি ভরাট করতে পারবেন না। এ তার সাধ্যের বাইরে। তিনিও তার আঁকা চিত্রের মতো স্বপ্ন-স্মৃতিভারে অতিশয় কাতর। অবনীন্দ্রনাথ তার বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ গ্রন্থটিতে শিল্পের তত্ত্ব হিসেবে যেসব মতামত ব্যক্ত করেছেন, তাও তার স্মৃতি স্বপ্নেরই অংশ মাত্র। তথাপি তিনি সর্বান্তঃকরণ দিয়ে কামনা করতেন, কেউ একজন আসুক যে আঁকবে নিটোল রক্তমাংসবিশিষ্ট সামাজিক মানুষের ছবি। বোধকরি সে আশায় বুক বেঁধে বেঙ্গল আর্ট স্কুলে শিক্ষকতার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এবং বাঙ্গলার ব্রত’ বইটি লিখেছিলেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাঙ্গলার ব্রত’ বইটি বাঙালি সমাজ জীবনের আনাচ কানাচ অনুসন্ধান করে বাঙালির শিল্পের প্রাণভোমরাটিকে সূত্রাকারে উপস্থিত করেছিলেন। একটি গভীর স্বাদেশিক এবং শৈল্পিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি এ কাজটি করেছিলেন। এই সমাজের সহজ সরল কিন্তু লীলায়িত শিল্প-নিদর্শন এবং অন্তরালবর্তী মটিফ’সমূহ আত্যন্তিক যত্নে নৃবিজ্ঞানীর দক্ষতা সহকারে শুধু সংকলন করেই ক্ষান্ত থাকেননি, তার ছাত্ররা যেন নিজেদের এ সকল ঐতিহ্য-সম্পদকে নিয়মিত চর্চা এবং ক্রমাগত নিরীক্ষার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন, সেদিকে তিনি সতত সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের সে প্রত্যাশার সবটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায়ের শিল্প-সাধনার মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের সে আকাক্ষার অনেকখানিই চরিতার্থতা লাভ করেছে।
.
৩.
নন্দলাল বসুই প্রথম ব্যক্তি যাকে প্রকৃত অর্থে সার্থক বাঙালি চিত্র-শিল্পীর শিরোপা দেয়া যেতে পারে। অবনীন্দ্রনাথের কুয়াশাচ্ছন্ন স্বপ্নমণ্ডিত তন্ময় পরিবেশের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে নন্দলালের রেখাপ্রধান চিত্রসমূহ বস্তু-ঘনিষ্ঠতা লাভ করে বাস্তব জগতে মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে দাঁড়াবার জন্য যেন সংগ্রাম করছে। তাই বলে নন্দলাল বসু পৌরাণিক চিত্র আঁকেননি এমন নয়। তবে তার পৌরাণিক চিত্রগুলো দেখেও মনে একটা ধারণা জন্মাবে যে, সেগুলো পৌরাণিক জগৎ থেকে মাটির পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। তার ধ্যানী বুদ্ধ ছবিটির কথা ধরা যাক। এখানে বুদ্ধদেবের ধ্যানমগ্নতাটাই সব নয়, তার রক্ত-মাংসের অস্তিত্বটাও ধরা পড়েছে। আবার যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ কিংবা মহাত্মা গান্ধীর ছবি আঁকেন রেখার বাঁকে বাঁকে একটুখানি পৌরাণিকতা যেন প্রাণ পেয়ে ওঠে। চলমান সাঁওতাল রমণীর চিত্রে যে ভঙ্গি ফুটে বেরিয়েছে তা অনেকটা এরকম, চিত্রটি সাঁওতাল রমণীর, কোনো সন্দেহ নেই। শরীরে যৌবন জ্বলছে, খোঁপায় দুলছে বনফুলের আভরণ, বলিষ্ঠ পায়ের গোছ, চলার ছন্দে বিজন বনভূমি ছন্দায়িত হয়ে উঠছে। এসব তো রয়েছেই। এটুকু না থাকলে শিল্প হবে কেমন করে? তবু, তবু কোথায় এ রমণীটির আদলের মধ্যে এমন কিছু আছে যেন একটুখানি ফুরসত পেলেই সে সাঁওতাল বেশভূষা পরিত্যাগ করে নারীত্বের একটা ইমেজ মাত্র হয়ে স্বপ্নলোক ধ্যানলোকের দিকে ধাওয়া করবে। নন্দলালের আঁকা বিরান মাঠের মাঝখানের তালগাছ দেখেও একইরকম ভাবনা জন্মাবে। এই তালগাছটি তালগাছ বটে, আবার তালগাছ নয়ও। সামান্য সুযোগ পেলেই অণু অণু স্বপ্ন হয়ে আকাশলোকের কোথাও মিলিয়ে যাবে । শিল্প-সাহিত্যে কেউ বাইরে থেকে ঘরে ফেরার সাধনা করে, কেউ ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার, যার যতদূর যাত্রা হয়, ততদূর সফলতা। নন্দলাল বসু এই বাইরে থেকে ঘরে আসার সাধনাই করেছিলেন। সবটা ফিরতে পারেননি। তথাপি নন্দলাল একজন বিরাট শিল্পী। বাংলার চিত্রশিল্পীকে লোকায়ত ও ধ্রুপদ, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য রীতির মিশেল ঘটিয়ে, নানা ভাঙচুরের মাধ্যমে একটি ফ্রেমের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।