সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে, বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম, ঘাম, সংঘাতের ভেতরে সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর পথ, পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনা এবং নিরীক্ষার অনেকগুলো পর্যায়। তার ব্যক্তি জীবন এবং শিল্পীজীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তাও কম বিস্ময়কর নয়। পরে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাবে। আপন অন্তরস্থিত সৌন্দর্যবোধ, নিসর্গ, ইতিহাস এবং জীবন্ত শ্রমশীল মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে ক্যানভাসে সবকিছু মূর্ত করে তোলা-এর সবটুকু তার একক শৈল্পিক-প্রয়াসের ফল নয়। তার জন্য এই সুপ্রাচীন দেশটিকে সাম্প্রতিককালে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ঘোষণা করতে হয়েছে। একটি উদ্ভিদ-সমতুল ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে, প্রতিটি সামাজিক স্তরের মানব সাধারণের ভেতর বন্দুকের আওয়াজে, কামানের হুংকারে যে জাগরণ এসেছে, যা তাদের সম্মিলিত সৃষ্টিশক্তির তেজ উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে, তার প্রয়োজন অপরিহার্য ছিল। ইনকুয়েবেটর যন্ত্রের তাপে ডিমের খোলস ফেটে যেমন করে মুরগির বাচ্চা প্রাণ পেয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উত্তাপে শিল্পীর অন্তর চিরে এসকল ছবি বেরিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু আবেগ, সবটুকু জীবনোল্লাস, সবটুকু স্পর্ধা এবং দুঃসাহস এই ছবিগুলো ধরে রেখেছে। এরকম একটি প্রলয়ঙ্করী ঘটনা না ঘটলে সুলতানের তুলি কস্মিনকালেও এরকম আশ্চর্য ছবি প্রসব করতে সক্ষম হতো না, যত প্রতিভাই তার থাকুক, কিষাণ-জীবনের প্রতি তার অনুরাগ-মমতা যতই নিবিড় গভীর হোকনা কেন। বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রামের একেবারে অন্তঃস্থল থেকেই এসকল চিত্রের উদ্ভব। এ কারণে এ ছবিগুলো দর্শকের মনেও প্রত্যক্ষভাবে ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। হয়তো দর্শক সচেতনভাবে অনুভব করতে পারেন না, কিন্তু অন্তরালে এই বোধ ক্রিয়াশীল থাকে ঠিকই। ইতিহাসের এই জাগ্রত দেবতার প্রতি অজানিত শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দলে দলে মানুষ এ সকল ছবি দর্শন করতে এসেছে। যুদ্ধে পরাজিত, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ ভেনিসের মরমে মরে যাওয়া জনসাধারণও আজ থেকে বহুকাল পূর্বে একদা তরুণ শিল্পী মিকেলেঞ্জোলোর অপূর্ব মূর্তি ডেভিডের দিকে ভেনিসের অপরাজেয় ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক হিসেবে মমতা-মেদুর নয়নে দৃষ্টিপাত করেছিল। আমাদের দেশের চিত্রশিল্পী এবং সমালোচক এ দুজাতের দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে এই পরিপ্রেক্ষিতের অবস্থিতির দরুন তারা এ অমর চিত্রসমূহের প্রতি শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে প্রণতি জানাতে পারেননি।
.
২.
শিল্পকলার সঙ্গে সামাজিক গতিশীলতার একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল। স্থবির সমাজের শিল্পকলাও বলতে গেলে একরকম পরিবর্তনবিমুখ। পুরুষ-পুরুষানুক্রমে সেখানে একইরকম পট আঁকা হয়, একই ধরনের মাটির পাত্র তৈরি করা হয়। নতুন পুরুষের অভিজ্ঞতার ব্যঞ্জনা, অভিযাত্রার প্রাণস্পন্দন স্থবির সমাজের ঐতিহ্য নির্ভর শিল্পকর্মে কদাচিৎ সঞ্চারিত হতে পারে। পুরুষ-পরম্পরা একইরকম প্রক্রিয়ার একই বস্তু প্রথাসিদ্ধ উপায়ে প্রস্তুত করা হয়, একে নির্মাণ বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। একটি অচল সমাজ ভেতর থেকে প্রাণ পেয়ে চলতে আরম্ভ করলে তার নানামুখী শিল্প-প্রয়াসের মধ্যে এই চলার বেগ, এই গতির ছন্দ নব নব ভঙ্গি এবং নব নব দ্যোতনার জন্ম দিয়েই চলে । শিল্পকলার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন আসতে থাকে এবং ঘটতে থাকে রূপান্তর।
সামগ্রিকভাবে বাংলার শিল্প-সাহিত্য ইংরেজি তথা ইউরোপীয় শিল্প-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটা নতুন বেগ, নতুন ভঙ্গি এবং নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। অর্থাৎ এই সময়ের পূর্ববর্তী বাংলার যে চিন্ময় সৃষ্টি তা পরবর্তী সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে না। পরবর্তীকালের চিন্ময় সৃষ্টিসমূহে এমন কতিপয় নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে; পূর্ববর্তী সময়ের যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম তন্নতন্ন করে দেখলেও যার সন্ধান পাওয়া যায় না। এই পরিবর্তন শুধু একা মৃন্ময় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে আসেনি, গোটা সমাজের ধনবণ্টন থেকে শুরু করে আচার-বিচার, চিন্তা ভাবনা, রুচি-পছন্দ, পোশাক-আশাক সবকিছুর মধ্যে এমনভাবে এসেছে যে সন্ধান করলে ধরা পড়ে যাবে সম্পূর্ণ মানব সম্পর্কের ধরনটিই অল্পবিস্তর পাল্টে গেছে এবং সমাজের কাঠামো বা ছকটির মধ্যেও অনেকদূর পালাবদল ঘটে গেছে। এই সামাজিক পালাবদলের যে সুবিশাল যজ্ঞ, সাহিত্যে তার গতিপরিক্রমা মাইকেল, বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে মুখ্যত ঝাঁক বেঁধে ফুটে উঠেছে। এসময়ের প্রাথমিক সাংস্কৃতিক প্রয়াসসমূহের মধ্যে একটা দ্বিমুখী মনোভঙ্গি সবসময়ে লক্ষ্যগোচর। একদিকে ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতির স্পর্শে স্রষ্টাকুল শিউরে শিউরে জেগে উঠেছেন আর অন্যদিকে এই জাগরণের বেগ-আবেগ ঐতিহ্যের ভেতর চারিয়ে দেয়ার জন্য ঐতিহ্যের ভিতটি নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন এবং সম্প্রসারিত করে যাচ্ছেন। সাহিত্য নব্য-ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের মনীষার স্পর্শ এবং বিত্তের সমর্থনে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কলেবর ধারণ করে। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত চিত্রকলার ভাগ্যে সে সুদিনের আগমন ঘটেনি। সমাজের সর্বসাধারণের মধ্যে চিত্রকলার প্রতি অনুরাগের অভাবই সেজন্য দায়ী। আর এক অংশ সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, ধর্ম-অর্চনা ইত্যাদির মাধ্যমে চিত্র-চর্চার যে চল ছিল তাতে ইউরোপ এবং ইউরোপীয়ানার কোনো প্রভাব সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে পড়তে পারেনি। তাছাড়া চিত্রকলার প্রসার এবং ব্যাপ্তির সঙ্গে সামগ্রিক সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নটিও বিজড়িত ছিল। তাই অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি চিত্রকরেরা স্বেচ্ছায় ইউরোপীয় চিত্রপদ্ধতির অক্ষম অনুকরণ এবং নবিশগিরি করেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপীয় চিত্রকরেরা যা আঁকতেন বাঙালি চিত্রকরেরা হুবহু তার কার্বন কপি তৈরি করতেন। এ অবস্থাটা বেশ কিছুদিন চলেছে। এই ইউরোপ-নবিশ চিত্রকরদের কারো অঙ্কন পদ্ধতিতে সৃষ্টিশীলতার ছন্দ সঞ্চারিত হয়নি। এ পর্যায়ের চিত্রশিল্পীদের কেউ দেশবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার কথা দূরে থাকুক, যে ইউরোপের অনুকরণ করেছেন দিবস-রজনীর প্রাণান্তকর পরিশ্রমে, তাদের সামান্য অনুমোদন পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতির অনুশাসন ছিন্ন করে একটা নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কারের হার্দ্য এবং মেধাবী প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। অন্ধ অনুকরণ প্রবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ রাজস্থানী, মোগল,অজন্তা, ইলোরা ইত্যাদি চিত্রকলার প্রতি সানুরাগ দৃষ্টিপাত করেন এবং এসবের মধ্যে তার অভীষ্টের সাক্ষাৎ পেয়ে যান। তাছাড়া সেসময়ে প্রখ্যাত জাপানী শিল্পী ওকাকুরা ঠাকুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন। প্রাচ্য শিল্পাদর্শের মহিমা। প্রচার এবং প্রাচ্যরীতির শিল্পের প্রসারকল্পে এই শিল্পী স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ওকাকুরা এবং অবনীন্দ্রনাথ দুজনে কে কাকে প্রভাবিত করেছিলেন বলা মুশকিল। মোটের উপর দুয়ের সাক্ষাতের ফলে একটা চরম অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।