১৯৭১
বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা
শেখ মুহম্মদ (এস. এম সুলতানের আঁকা গুরুভার নিতম্ববিশিষ্টা পীনস্তনী এসকল চমৎকার স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা লীলাচঞ্চলা নারী, স্পর্ধিত অথচ নমনীয় সর্বক্ষণ সৃজনলীলায় মত্ত, অহল্যা পৃথিবীর প্রাণ জাগানিয়া এসকল সুঠামকান্তি কিষাণ, এসকল সুন্দর সূর্যোদয়, সুন্দর সূর্যাস্ত, রাজহাঁসের পাখনার মতো নরম তুলতুলে এসকল শুভ্র শান্ত ভোর, হিঙুলবরণ মেঘ-মেঘালীর অজস্র সম্ভার, প্রসারিত উদার আকাশ, অবারিত মাঠ গগন ললাট, তালতমাল বৃক্ষরাজির সারি, দীঘল বাকের, নদীতীরের এসকল দৃষ্টি-শোভন চর, মাঠের পর মাঠে থরে থরে ঢেউ খেলানো সোনার ধান, কলাপাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকজ্বলা এমন মোহিনী অন্ধকার, আঁকাবাকা মেঠো পথের বাঁকে বাঁশ-কাঠে গড়া কিষাণের এসকল সরল আটচলা, এসকল আদী বাছুর এবং পরিণতবয়স্ক গবাদি পশু, সর্বোপরি গোটা জনজীবনে প্রসারিত উৎপাদন শৃঙ্খলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অজেয় মানুষ; তারা যেন দৈনন্দিন জীবনধারণের স্রোতে কেলিকলারসে যুগ থেকে যুগান্তর পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে, ক্যানভাসে তাদের প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ ঋজু গতিভঙ্গিমা এমনভাবে বাঁধা পড়েছে, মনে হবে সমস্ত নিসর্গ দৃশ্য ছাপিয়ে মেঘেতে ঠেকেছে তাদের মস্তক এবং পাতালে প্রবিষ্ট হয়েছে মূল, তাদের শ্রম-ঘামের ঝংকার, চেষ্টার সঙ্গীত সমস্ত প্রাকৃতিক কোলাহল ভেদ করে আকাশ গঙ্গার কিনারে কিনারে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনিতে একসঙ্গে ফেটে পড়ছে।
শহরের চৌমোহনার ইট-সিমেন্টের পুরো কঠিন আবরণ ফাটিয়ে একটা আস্ত ঝর্না যদি বন্য আদিম ভঙ্গিমায় জেগে উঠে রঙিন জলধারা হঠাৎ করে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করতে থাকত, পৃথিবীর অন্তরের এই নৃত্যপরায়ণ রসধারার প্রতি মানুষ যেমনি বিস্ময়াবিষ্ট নয়নে দৃষ্টিপাত করত; তেমনি চোখে মানুষ সুলতানের আঁকা এসকল ছবি দেখেছে। এই ছবিগুলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবে বাংলার অস্পষ্ট, ঝাঁপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন, অবগুণ্ঠিত অতীত খুঁড়ে প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে উপরের সমস্ত নির্মোক বিদীর্ণ করে শিল্পীর পারঙ্গম তুলির মাধ্যমে আমাদের যুগ এবং আমাদের কালের ঘাটে এসে আছড়ে পড়েছে। তারপর কোনোরকম ভনিতা না করেই বাংলাদেশের চিত্র-দর্শকদের উদ্দেশ্যে অমোঘ নির্দেশবাণী উচ্চারণ করেছে: আমাদের দেখো । বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং মজেছে। রঙের পরশ দৃষ্টিপট ভেদ করে মনের পটে অক্ষয় হয়ে স্থির ইন্দ্রধনুর মতো ফুটে গেছে। গ্রাম বাংলার এই চলমান ইতিহাস প্রবাহের সঙ্গে দর্শকের তন্ময় সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। তারা নিজেদের অস্তিত্বকেও এসকল কান্তিমান, আয়ুষ্মান চিত্রের অংশ হিসেবে মনে করতে বাধ্য হয়েছে।
সকলে চিত্রকলার মর্ম বোঝে না, সূক্ষ্ম বোধ এবং উপলব্ধি অনেকের না থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষত সেই ইতিহাস গাজন-উৎসবের নটরাজের মতো অট্টরোলে যখন নেচে ওঠে। সুলতান বছর তিনেক আগে শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তার সর্বশেষ প্রদর্শনীটিতে বাংলার আবহমানকালের ইতিহাসকে নাচিয়ে দিয়েছেন। যারাই এ চিত্রগুলো দেখেছেন, তাদের উপলব্ধিতে একটি কথা ভ্রমরের মতো গুঞ্জরণ করেছে। আমাদের সভ্যতার প্রাণ কৃষি আর কিষাণ হলো সভ্যতার নাটমঞ্চের একক কুশীলব। যখন মানুষের কানে মহাকাশ আর মহাপৃথিবীর শ্যামের বেণু অপূর্ব সুরলহরী বিস্তার করে তাকে ক্রমাগত মর্তলোকের সীমানা থেকে ঊর্ধ্ব, ঊর্ধ্বতর লোকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখনো এই প্রাচীন ভূখণ্ডটিতে আদলে এবং অবয়বে মানুষ সেই সনাতন মানুষই রয়ে গেছে। তাই সুলতানের আঁকা এই মানুষেরা বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ। যেখানেই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে সেখানেই আদিপিতা হলধর আদমের চেহারায় তারা উপস্থিত ছিল। তারা মিশরে ছিল, চীনে ছিল, ভারতে, ব্যবিলনে, গ্রিসে, রোমে সবখানে বন কেটে বসত গড়ার দিনে, মাটির মর্মমধু টেনে তোলার বেলায়, বনের অগ্নিকুণ্ড পরিত্যাগ করে ঘরের দাওয়ায় সান্ধ্য-প্রদীপ জ্বালবার নম্ন-মধুর ক্ষণে তারা হাজির ছিল। যেখানেই মাটি শ্রমশীল কর্মিষ্ঠ মানুষের শ্রমে যত্নে প্রসন্ন হয়ে ফুল-ফসলের বর দিয়েছে, উপহার দিয়েছে শান্ত স্নিগ্ধ গৃহকোণ, সেখানেই ইতিহাস গতিচঞ্চল পথ পরিক্রমার সূচনা করেছে। মাটি এবং মানুষের এই দ্বৈত সম্পর্ক, বিশদ করে বলতে গেলে, নিসর্গ এবং মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুলতানের আঁকা চিত্রমালায় এমন আকার পেয়েছে, এমন বরণ ধরেছে যে একান্ত নির্জীব এবং পাষণ্ড না হলে তার আবেদন অস্বীকার করা প্রায় একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলার বদলে সুলতান যদি আরব দেশে জন্ম নিতেন, মরুচারী বেদুইনদের ছবি আঁকতেন। যদি জন্মাতেন নরওয়ে, সুইডেনে তাহলে সমুদ্রচারী জেলেদের সভ্যতার পথিকৃৎ হিসেবে আঁকতেন। নেহায়েত বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন বলেই এই কৃষকদের সভ্যতার জনয়িতা ধরে নিয়ে ছবি এঁকেছেন। সুন্দর প্রকৃতিতে নয় মানুষের মনই সৌন্দর্যের নিবাসভূমি। চারদিকে দৃষ্টিরেখা যতদূর ধাবিত হয় এবং সামনে পেছনে চিন্তা-কল্পনা অনেক দূর বিহার করার পর যে অনড় বিন্দুটিতে এসে স্থির হয়, সংহত হয়, সেইখানে, কেবল সেইখানেই সৌন্দর্যের নিভৃত নিকুঞ্জ। সেজন্য একজন আরবের চোখে লু হাওয়া তাড়িত ধু-ধু মরুভূমি সুন্দর, একজন এস্কিমোর চোখে তুষার-আচ্ছাদিত ধবল তুন্দ্রা সুন্দর।