বাঙালি মুসলমানের উল্লেখ করার মতো কোনো কীর্তি ছিল না। কিন্তু বাঙালি মুসলমান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এটাই তার সবচাইতে বড় এবং অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ কীর্তির পাশে অন্যবিধ কীর্তিগুলো ম্লান হয়ে যায়। এখানে একটা কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে। আমি বাঙালি মুসলমান বাঙালির জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছে এই কথাটি। বলে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দাবি খারিজ করিনি। বাংলাদেশে সংখ্যাধিক মানুষ মুসলমান এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা সবচাইতে প্রণিধানযোগ্য সে কথাটি মনে রেখে বলেছি বাঙালি মুসলমান একটি বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি এই জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা পালন করেনি সে কথা আদৌ সত্য নয়।
ইতিহাসে বিশ-ত্রিশ বছর কোনো দীর্ঘ সময় নয়। বাঙালি মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের সংকটের অন্ত নেই, কোথাও কোনো দিক-নির্দেশনার চিহ্ন পরিদৃশ্যমান নয়। সামাজিক সভ্যে এবং ধর্মীয় কুসংস্কার সাম্প্রতিককালে এমন প্রচণ্ড আকার নিয়ে দেখা দিয়েছে, অনেক সময় মনে হয় এই জাতি মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে না। মধ্যযুগীয় ভূত এই জাতিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তার নাগপাশ কখন কিভাবে ছাড়াতে পারবে একথা এখন একরকম চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান অস্থিরতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় বদ্ধমতের পুনরুত্থানের একটি কারণ আমি নির্দেশ করতে চাই। শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে দলটি গিয়েছিল তার আদর্শিক বৃত্তটি বিশ্লেষণ করলেই সেটি ধরা পড়বে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যান্য দলও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং একথা বলা একটুকুও অযৌক্তিক হবে না যে, মূলত আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের একটা অংশ। পাকিস্তানের সঙ্গে বাস করে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছিল না বলে আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছিল।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তাৎপর্যের দিক দিয়ে দুটি এক জিনিস নয়। এই আওয়ামী লীগের আন্দোলন যতই বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করেছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ভেতর তারা কোনো নতুন মূল্য চিন্তার জন্ম দিতে পারেনি; নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারেনি। তারা সেকুলারিজমের নীতিকে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব সপরিবারে যখন নিহত হলেন তখন তার অনেকদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। মূলত আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যারা আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তাই তার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। মুশকিলের কথা হলো আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন মুষ্টিমেয় নেতা বা নেত্রীর বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় গোটা বাংলাদেশটাই পরাজিত হয়, আওয়ামী লীগের যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অনেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমাজে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলতে জানেন না। তাদের কথা অনেক সময়ে মনে হয় ভারতের তথাকথিত সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা দেশের ভেতরে সেকুলারিজম আবিষ্কার করতে অক্ষম। বাইরে থেকে সেকুলারিজম আমদানি করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখানেই আমাদের জাতি এবং সমাজ জীবনের যাবতীয় বিপত্তির উৎস। মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতির ভেতরে একটা সেকুলারিজম-এর ভিত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের জনগণের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শেষ কথা আমি এই বলতে চাই যে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় সংস্কারে পীড়িত মুসলিম সমাজের দিকে অত্যন্ত সাহস নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে তাকাতে হবে। মধ্যযুগীয় সমাজকাঠামোর ভেতরে আধুনিক সমাজের বীজ রোপণ করে প্রাচীন সমাজ কাঠমো ফাটিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটি যেদিন হবে বাঙালি এ জাতীয় রাষ্ট্রটি আপন শক্তি এবং শৌর্য নিয়ে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রটি জন্ম দিয়েছে সেটি ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সবচাইতে আধুনিক রাষ্ট্র। এই আধুনিক রাষ্ট্রের দাবি এবং প্রয়োজনটি স্বীকার করে নিয়ে সঠিক রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা লাভ করলে বাংলাদেশ বাঙালি জনগোষ্ঠীর সত্যিকারের আশ্রয়স্থল হিসেবে পৃথিবীতে গৌরবের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বুক পয়েন্ট গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে সাহসী হয়েছেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। অন্য সকলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা অন্তহীন।