‘বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে’ লেখাটি লেখা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তখন প্রয়াত কবি সিকান্দার আবু জাফর কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকাটি প্রকাশ করতেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা বিষয়ক সেমিনারে পাঠ করার জন্য ‘শিক্ষার দর্শন’ শীর্ষক রচনাটি লিখিত হয়।
একটু ভুল হয়ে গেল। ছাত্র থাকার সময়ে যে সকল প্রবন্ধ লিখেছি ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ও সেই পর্যায়ভুক্ত রচনা। লেখাটি ড. আহমদ শরীফের বাড়িতে পাঠচক্রের একটি সাপ্তাহিক সভায় পঠিত হয়েছিল।
প্রথম সংস্করণে যে সকল রচনা প্রকাশিত হয়েছিল অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় বর্তমান সংস্করণটিতে চারটি প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হলো। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটিতে অন্তত তিনটি রচনা স্থান পেয়েছে; যেগুলোর জন্য আমি সামান্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারি। প্রথমত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের একটি চরিত্র প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করব। হোসেন মিয়ার চরিত্রটিকে আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছি সেটি একেবারে নতুন। ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যে কোনো সমালোচনা মানিকের সৃষ্ট ওই অপূর্ব চরিত্রটির এরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাননি।
গৌতম ঘোষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির যে চিত্ররূপ দিয়েছেন তাতে খুঁটিয়ে বিচার করলে আমার এ প্রবন্ধটির প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। গৌতম যে উৎকৃষ্ট ছবি করতে পারেননি সেই দোষ তো আমার নয়। আমি তো চরিত্রটির সঠিক ব্যাখ্যা করেছিলাম।
দ্বিতীয় যে প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করতে চাই সেটি হলো ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : এবং সুলতানের সাধনা’। এই বিশেষ রচনাটি লিখতে পারার কারণে আমি মনে করি একটা বড় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করেছি। পঞ্চাশের দশকের দিকে শিল্পী এস. এম. সুলতান ইউরোপ আমেরিকায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কনটেমপরারি গ্রেট মাস্টার্স পিকাসো, ডালি, মাতিস, পল ক্লি প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ কথা সত্য বটে। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরে তার কথা লোকে একেবারেই ভুলে যায়। তিনি নড়াইলের কৃষিজীবী সমাজের সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে জীবন যাপন করতে থাকেন। এখানে ওখানে কিছু ছবি এঁকেছেন। শিশুদের আঁকার তালিম দিয়েছেন। গাঁজা চরস টেনে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। ১৯৭৬ সালে দেশে আসার প্রায় ত্রিশ বছর পর শিল্পকলা একাডেমীতে সুলতানের একটি চিত্র প্রদর্শনী হয় এবং এতে পাঁচশর মতো ছবি স্থান পেয়েছিল।
আমাদের দেশের শিল্পী এবং চিত্র অনুরাগী মহল সুলতানের এই অমর চিত্র সমূহের প্রতি কোনো অনুরাগ দেখাতে পারল না- এ ঘটনাটা আমাকে ভয়ংকর রকম ব্যথিত করে। এই শহরবাসী মানুষদের এই নীরব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সুলতানের প্রতিভা যথাযথভাবে দেশের মানুষদের সামনে তুলে ধরার একটা তীব্র আকাক্ষা আমার মধ্যে জাগ্রত হয়। আমি পেশাদার চিত্রসমালোচক ছিলাম না; শিল্পেও আমার কোনো রকমের অধিকার বোধ ছিল না। প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব সত্ত্বেও সুলতানের উপর দীর্ঘ প্রবন্ধটি আমি রচনা করি। এ লেখায় সুলতানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরদের একজন হিসাবে চিহ্নিত করার কারণে আমাদের দেশের ছবি আঁকিয়েদের কাছ থেকে অনেক খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। এটা গেল এক দিক। আরো একটা দিক রয়েছে। এ রচনাটি প্রকাশিত হবার পর শিল্পী সুলতানকে নতুনভাবে বিচার করার একটা প্রক্রিয়াও এখানে শুরু হয়। মূলত আমার রচনার বিশ্লেষণধারা অনুসরণ করে তরুণ চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ সুলতানের জীবন অবলম্বন করে ‘আদম সুরাত’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেন। দেশের একজন প্রথিতযশা কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই ‘সুলতান’ উপন্যাসটি লিখেন। সুলতানকে ঘিরে এক ব্যাপক কর্মতৎপরতার সূচনা হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই একটি জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে সুলতানের নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাকে রাষ্ট্রীয় শিল্পীর মর্যাদা দেয়া হয় এবং সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানও তাকে দেখানো হয়। অনেকগুলো দেশ থেকে চিত্র প্রদর্শনী করার আমন্ত্রণ আসে। সুলতানের অসুস্থতার কারণে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে জার্মানিতে তার নামে একটি মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে যে সুলতানের জন্মস্থান নড়াইলে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এ উদ্দেশ্যে সরকার দেড় কোটি টাকা অনুদান বরাদ্দ করেছে। আমার ধারণা সুলতান সম্পর্কিত লেখাটি প্রকাশিত না হলে আমাদের দেশ ও পৃথিবীর সামনে সুলতানের এই নতুন পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হতো না। সুলতান একজন মহান শিল্প ব্যক্তিত্ব, তবু আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছে, হয়তো এ প্রবন্ধটি না লিখলে সুলতানের পরিচয়টি এমনভাবে ঝালিয়ে তোলা সম্ভব হতো না।
এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম নাম প্রবন্ধ বাঙালি মুসলমানের মনের উপর আরো কিছু কথাবার্তা বলব। আমি বাঙালি মুসলমান সমাজের সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, বাঙালি মুসলমান রচিত কোনো শৈল্পিক এবং দার্শনিক সৃষ্টি কোনোরকম তাৎপর্য দাবি করতে পারে না। তার কারণ, এই সমাজ বাইরের দিক দিয়ে পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাপে চাপে বাধ্য হয়ে অল্পবিস্তর পরিবর্তিত হলেও তার কৌম সমাজের মনের গণ্ডীবদ্ধতার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাঙালি মুসলমানের সমষ্টিগত মনের প্রসারহীনতার একটি মুখ্য কারণই আমি নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছি। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত ছিল না বলেই তার মনের ধরনধারণটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের মতো থেকে গেছে। মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাই তার জাগতিক অগ্রগতির উৎস। বাঙালি মুসলমান চিন্তাই করতে শেখেনি। তার কারণ, কখনো সে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার অধিকার পায়নি। একটি রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে একটি সমাজ বিশ্ব সমাজের অংশে পরিণত হয় এবং বিশ্বসভায় একটি আসন অধিকার করে।