‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই গ্রন্থের পক্ষে বিপক্ষে নানা ব্যক্তি অভিমত প্রকাশ করতে থাকেন। আমার এই রচনার বিরূপ প্রতিক্রিয়াসমূহের মধ্যে থেকে কয়েকটির কথা আমি তুলে ধরতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক (ভূতপূর্ব সভাপতি, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি) আবুল কালাম আজাদ জনাব অলি আহাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় অন্যূন ছয় মাস ধরে আমার লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে একটানা লিখে যেতে থাকেন। এই হ্রস্বকায় করিতকর্মা অধ্যাপককে যিনি জানেন, অবশ্যই একমত হবেন, তার প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা কি রকম ভয়ংকর হতে পারে। আজাদ সাহেব ইত্তেহাদ পত্রিকায় নিবন্ধসমূহ লিখে নিবৃত্ত হতেন না, তার নিবন্ধ সংবলিত পত্রিকাটি প্রতি সপ্তাহে আমার দরজার তলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে যেতেন। আমি তখন থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে এবং তিনি থাকতেন আমার পেছনে শিক্ষকদের কোয়ার্টার্সে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভালমন্দ যাই লিখুক না কেন আমি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করব না। কারণ আমি আবুল কালাম আজাদ সাহেবের কৌশলটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। তিনি তার লেখাগুলো পাঠ করিয়ে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছিলেন। আমি ঠিক করেছিলাম তার ফাঁদে কিছুতেই ধরা দেব না। তাই দরজা খুলে যখন দেখতাম একটা ইত্তেহাদ পত্রিকা মেঝের উপর শুয়ে আছে, আমি কালবিলম্ব না করে সেটা জ্বালিয়ে ফেলতাম। তারপর আবুল কালাম আজাদ সাহেব একটা ভিন্নপথ ধরলেন। ইত্তেহাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলো দিয়ে তিনি একটা পুস্তিকা প্রকাশ করলেন এবং সেই পুস্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করে এলেন। কিন্তু শিক্ষকরা কেউ উচ্চবাচ্য কিছু করলেন না। এই ছোট মানুষটি মোটেই দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি এক শুক্রবারে স্বরচিত পুস্তিকাটি হাতে করে কাঁটাবন মসজিদে এলেন। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের কাছে নিবেদন করলেন, আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুদের জারজ সন্তান বলেছে। সুতরাং তার একটা বিহিত হওয়া দরকার। আমার ধারণা মুসল্লি সাহেবরা আবুল কালাম সাহেবের চরিত্র জানতেন, তাই তারা চেতে ওঠার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করেননি।
এভাবে তো আবুল কালাম পর্ব ছুটল। এরপর আক্রমণ এল সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে পর পর দু-সংখ্যায় একটি লেখা প্রকাশিত হলো। এক ভদ্রলোক ছদ্মনামে এ রচনাটি প্রকাশ করেছেন। পরে আমি এ ভদ্রলোকটির নাম পরিচয়ও উদ্ধার করতে পেরেছি। তিনি ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য এবং পরবর্তীকালে জিয়া সরকারের একজন মন্ত্রী। যতই নিন্দে সমালোচনা হোক তথাপি লেখাটির মধ্যে একটা শক্তি ছিল যা আমাদের দেশে প্রধান এবং খ্যাতনামা গদ্য লেখকদেরও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
আমি যে যুক্তি শৃঙ্খলা প্রয়োগ করে বাঙালি মুসলমানের মানসজীবন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নিয়েছিলাম আমার সেই চিন্তন পদ্ধতিটি অনেকেই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রতি সামান্য ঋণের কথা উল্লেখ করলে তাদের সম্মানহানি ঘটে সেজন্য আমার নামটি একেবারেই উল্লেখ করেন নি।
একটা দুঃখের কথা বলি, একবার বাংলা একাডেমী সিদ্ধান্ত নিলেন তারা একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করবেন। যে সংকলনে বাংলা সাহিত্যের প্রধান গদ্য লেখকদের রচনা স্থান পাবে। একেবারে কনিষ্ঠ লেখক হিসাবে আমারও একটি লেখা গ্রহণ করবেন বলে ঠিক করেছেন। আমাকে যখন একটি লেখা দিতে বলা হলো আমি ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি একাডেমীতে জমা দিলাম। কিছুদিন পর একাডেমীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, সম্পাদকমণ্ডলী আমার রচনাটি বিশেষ কারণে গ্রহণ করতে পারছেন না, আমি যেন তাদেরকে অন্য একটি রচনা দিয়ে বাধিত করি। এই সংবাদটি শুনে আমি অত্যন্ত চটে যাই এবং একাডেমীকে চিঠি লিখে জানাই, প্রস্তাবিত প্রবন্ধ সংকলনের যে চারজন সম্পাদক রয়েছেন তাদের মধ্যে তিনজনই এই লেখা থেকে মালমসলা সংগ্রহ করে দেদার লেখা লিখে যাচ্ছেন। সম্পাদকবৃন্দ কি কারণে এই রচনাটি গ্রহণ করতে চাননি আমাকে লিখে জানালে বাধিত হব। একাডেমী আমাকে কোনো কিছু জানাননি এবং সেই গদ্য গ্রন্থটি অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি, যদিও লেখকদের সম্মানী পরিশোধ করা হয়েছিল।
আমাকে এই প্রবন্ধটি সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলতে হবে এবং বলব রচনার শেষ পর্যায়ে। এখানে একটি সংবাদ জানিয়ে রাখতে চাই। কলকাতাতে যখন গ্রন্থটি প্রকাশ হতে যাচ্ছিল সে সময়ে মিরান্দা প্রকাশনীর শ্রীমতি পাপিয়া রায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সদ্য প্রয়াত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন। তারপর থেকে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের প্রাক্কালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একটি কর্তব্য বলে মনে করছি।
এই গ্রন্থে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ছাড়াও আরও কিছু রচনা স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে ‘ভবিষ্যতের ভাবনা’ রচনাটি আমি লিখি ছাত্রজীবনে। রচনাটি জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আইয়ুব খান সাহেবের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন যখন রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার ঘোষণা দেন, সেই সময়ে আমি আমার এক বন্ধু কাজী সিরাজ মিলে ঠিক করি এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত পরিচিতিসম্পন্ন তরুণ-প্রবীণ কবি-লেখকদের রচনা সংগ্রহ করে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করলে সবচাইতে ভাল হয়। আমরা প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজকে এই প্রস্তাবিত গ্রন্থটি প্রকাশ করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি করাই। তারপর আমাদের শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান সাহেবকে এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করতে অনুরোধ করি এবং তিনি রাজিও হন। এই উপলক্ষে আমি ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’ শীর্ষক লেখাটি লিখি। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না ওই সংকলনে এটি ছিল একমাত্র ছাত্রলিখিত রচনা। আমার লেখাটির অংশবিশেষ প্রয়াত সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় স্টেটসম্যান পত্রিকায় ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।