এই গ্রন্থের লেখাগুলো সূচি অনুসারে না দেখে লেখার কালানুসারে বিচার করলে লেখকের মানস পরিণতির একটা ছায়া বোধ করি দৃষ্টিগোচর হবে।
রচনাগুলো প্রেসে দেয়া হয়েছিল তিন বছর আগে এবং প্রায় অর্ধেকের বেশি ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এতদিন পর। সেই দুঃখের কথা বলে লাভ নেই। তবু ভাবতে ভাল লাগছে ১৯৮১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো।
বিনীত
আহমদ ছফা
২১ ফেব্রুয়ারি ’৮১
১০৭ আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.
উত্তর ভূমিকা
এই গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি লেখার পেছনে সামান্য ইতিহাস আছে। তখন জিয়াউর রহমানের রাজত্বকাল। অধ্যাপক আবুল ফজল তার শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা। আবুল ফজল সাহেবের সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল এবং তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার গল্প উপন্যাস এবং প্রবন্ধের উপর তিনি তিনটে প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখক জীবনে আবুল ফজল সাহেবের কাছে আমি অনেক পরিমাণে ঋণী। তিনি আমার মতো অনেক তরুণেরই প্রেরণার উৎস ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির পূজারী এবং ঘঘাষিতভাবে নাস্তিক। যেহেতু ফজল সাহেব নাস্তিকতা প্রচার করতেন, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ লোকেরা তাকে ভীষণ খারাপ চোখে দেখত এবং প্রায়ই পত্র পত্রিকায় তাকে গালাগাল করা হতো।
একদিন সকালবেলা আমি প্রাতভ্রমণ করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছি। খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম সকালবেলা আবুল ফজল সাহেব মোটাতাজা উঁচা লম্বা ফর্সা মতোন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছেন। তার মাথায় একটা গোল টুপি। আবুল ফজল সাহেবের মাথায় টুপি দেখে আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জানালেন, সিরাত মাহফিলে যোগ দেবেন বলে বেরিয়েছেন। তার সঙ্গের মানুষটির পরিচয়ও আমি পরে জানতে পেরেছি। তিনি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের আকাশ সেনা প্রধান জনাব এম এ জি তাওয়াব। ধর্ম নিয়ে অত্যধিক বাড়াবাড়ির কারণে এই ভদ্রলোক জিয়াউর রহমানকে অনেকবার বেকায়দায় ফেলেন। শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়া তাওয়াব সাহেবকে তার শ্বশুরের দেশ জার্মানিতে চলে যেতে বাধ্য করেন।
আমি আবুল ফজল সাহেবকে টুপি পরে সিরাত মাহফিলে যোগ দিতে যাওয়ার ঘোষণা শুনে মনে মনে একটা চোট পেয়ে গেলাম। এই ঘোষিতভাবে নাস্তিক ভদ্রলোকটি আজকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে না পেতে নিজেকে প্রচণ্ড ধার্মিক বলে পরিচয় দিতে চাইছেন। এরকম কাণ্ড কি করে ঘটে সেটা আমাকে ভয়ানক রকম চিন্তিত এবং উতলা করে তোলে।
অনেক নাস্তিক শেষ পর্যন্ত আস্তিকে পরিণত হয়েছে এরকম ভুরিভুরি লোকের নাম আমি জানি। কিন্তু আবুল ফজল সাহেবের মতো লোক যিনি সারাজীবন নাস্তিকতার পুরোহিতের ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে না আসতেই কোনোরকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না দিয়েই একটি ভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে চিহ্নিত করতে তৎপর হয়ে উঠলেন সেটাই আমাকে সবচাইতে বিস্মিত করেছে।
এই যে হঠাৎ পরিচয় পাল্টে ফেলা তার পেছনে আমার মনে হয়েছিল একগুচ্ছ সামাজিক কারণ বর্তমান। আবুল ফজল সাহেব উপলক্ষ মাত্র, কারণ নন। বাঙালি মুসলমান সমাজের ভেতরে এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে যেগুলো ব্যক্তিকে কোনো বিশ্বাসের বিন্দুতে স্থির থাকতে দেয় না। ডানে কিংবা বাঁয়ে হেলতে বাধ্য করে। মনের এই উত্তেজিত অবস্থাতে আমি এক রাতে একটুও না থেমে বাঙালি মুসলমান রচনাটি লিখে শেষ করি।
লেখাটি যখন প্রথম সমকালে প্রকাশিত হয়, আমাদের দেশের চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে কিছু আলোড়নও আমি লক্ষ্য করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ আমার লেখার তীব্র সমালোচনা করে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে আমাকেও ওই একই সমকাল পত্রিকায় জনাব এবনে গোলাম সামাদের অভিযোগের একটা কড়া জবাব দিতে হয়।
বর্তমান গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ার প্রায় দুবছর পরে বাংলা একাডেমী ছাপার কাজ শুরু করে। লেখাটি যখন চার ভাগের তিন ভাগ ছাপা শেষ হয়েছে একাডেমী কর্তৃপক্ষকে আমি অনুরোধ করি শেষের দিকে আমি এই গ্রন্থে একটি বড়সড় লেখা সংযোজন করতে চাই এবং সেজন্য তাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে সামান্য অস্বস্তি ছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজকে নানা দিক থেকে আমি অভিযুক্ত করছি অথচ আমার জন্ম এই সমাজে ঘটেছে। এই সত্য কোনোদিন অস্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। নিজের সমাজের অবিমিশ্র নিন্দে করে কোনো মানুষ ভাল কিছু করতে পারে না। সেজন্য আমি মনে মনে অনুসন্ধান করছিলাম এমন কিছু খুঁজে পাই কিনা, যা দিয়ে বাঙালি মুসলমানের দিক সামান্য হলেও আমি উল্লেখ করতে পারি।
এই রচনা লেখার প্রায় পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গে প্রয়াত শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং পরিচয় পরে বন্ধুত্বে রূপ নেয়। সুলতানকে আমার বাঙালি মুসলমান সমাজে নয় শুধু গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একজন অনন্যসাধারণ মানুষ বলে মনে হয়। আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই মহান শিল্পীর প্রতি উপেক্ষা এবং তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে যে পাপ করে আসছিল সেই পাপ স্খলনেরও একটা পন্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা আমি তীব্রভাবে অনুভব করে আসছিলাম। যেভাবে সুলতান এবং তার শিল্পকর্ম দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন সেই জিনিসটি তুলে আনতে পারছিলাম না বলে আমাকে ক্রমাগত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই সময়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ পৃষ্ঠা বিস্তৃত রচনাটি আমি শেষ করি এবং তার পরে বাংলা একাডেমী বইটি প্রকাশ করে।