এ ছাড়াও শিক্ষা ব্যবস্থা ভিন্নদিক দিয়েও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। কারিগরি এবং যন্ত্রবিজ্ঞানে শিক্ষিত ছাত্রগণ সমাজের মানব সম্পর্ক নির্ণয়ের বিষয়ে অজ্ঞই থেকে যান। অনেক সময় এই কারিগরি এবং যান্ত্রিক প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষার্থী মানব জাতির কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে চিন্তা করার কোনো অবকাশই পান না। তাদের কোনো কাজের জন্য যে মানব জাতির কিছু যায় আসে, এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। আর তার অবকাশও নেই। অন্যদিকে মানববাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রয়োগের কারণে মানুষের সমাজে স্থূল সূক্ষ্ম কি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে ব্যাখ্যা বিচার করে সাধারণের কাছে বোধগম্য করে তুলতে পারছেন না। তার ফল দাঁড়াচ্ছে, একটি সমাজের মধ্যেই অনেক সমাজ সৃজিত হচ্ছে, অথচ এই অন্তবর্তী সমাজগুলোর মধ্যে হার্দ্য কোনো সংযোগসূত্র নেই এবং কোনো ন্যায় অন্যায়ের জন্য কাউকে দায়ী করারও কোনো পন্থা নেই। রেনেসাঁ পূর্ব ইউরোপ এবং প্রাচীন পৃথিবীতে যেমন হয়েছিল, তেমনি রাষ্ট্রভিত্তিক, যন্ত্র এবং যান্ত্রিকতাভিত্তিক ও কলাভিমানী ব্যক্তিদের অভিমানভিত্তিক অনেকগুলো ডগমা বা বদ্ধ সংস্কার হালের পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করেছে।
.
৪.
ভাবী সুষ্ঠু শিক্ষা দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু কি হওয়া উচিত? এক কথায়, এর উত্তর দেয়া সহজসাধ্য নয়। সভ্যতার বিস্তার, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসার এবং সাক্ষরতার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রভুত্বপরায়ণ জাতিগুলোর অহংপুষ্ট ধারণায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। কোনো জাতি এককভাবে সভ্যতার একচেটে মুদির দোকানী এই দাবি অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে করতে পারবে না। সভ্যতা কোনো দেশ জাতি বা সম্প্রদায় বিশেষের সম্পত্তি নয়-অথচ প্রতিটি তথাকথিত সুসভ্য জাতির মধ্যেই এই সভ্য অভিমান প্রচণ্ডভাবে লক্ষ্য করা যায়। বাইরের দিকে হয়তো দেখা যায় না– কিন্তু গ্লাসিঅরের মতো ভিতরের দিকে অনেকদূর সুসংহত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ যা সৃজন করেছে, নিজের বোধবুদ্ধিকে যতদূর মুক্তি দিতে সম্ভব হয়েছে তা সংকীর্ণ দেশীয়তা আর জাতীয়তার মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, অন্যদিকে জৈব প্রয়োজনেই দেশসীমা জাতিসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। এইখানেই হলো যাবতীয় বিপত্তির উৎস। যেহেতু মানুষ বলবান শীলিত বুদ্ধির প্রয়োগে এই দ্বন্দ্বের কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি, তাই রবোট হওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়েও তাকে রবোটে পরিণত হতে হচ্ছে। এটা হচ্ছে এই কারণে যে মানব জীবনে চূড়ান্ত লক্ষ্য কি সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা। আগেকার নবী পয়গম্বরেরা মানব জীবনের চরম পরম লক্ষ্য বলতে বুঝতেন পরম সত্তার জ্ঞান। এই কালের মানব জীবনের পরম লক্ষ্য কি? সম্ভবত মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা বিকশিত করে তোলাই যদি বলা হয়, আশা করি অন্যায় হবে না। কিন্তু দেশ, জাতি এবং সম্প্রদায় বিভক্ত পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত সম্ভাবনার বিকাশ সাধন সম্ভব নয়, যেমন উপজাতীয় সমাজে যন্ত্রবিজ্ঞানের কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। মানব জাতি এক, তাদের স্বার্থ, কল্যাণ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। সমস্ত মানুষকে এক জাতিভুক্ত, গোটা পৃথিবীকে একটি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত, মানুষের সমস্ত প্রবৃত্তিকে কোনো রকমের পূর্বসংস্কার ব্যতিরেকে নির্মোহভাবে অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় ধরে নিয়ে, জীবন আরো সুন্দর, মানুষ আরো ভাল এবং স্বাধীনতা আরো কাঙ্ক্ষিত ধন- কোনো রকমের স্বর্গ নরকের ভয়ভীতিহীন জীবনের নব দর্শনের মধ্যেই রয়েছে আগামীর মহীয়ান শিক্ষাদর্শনের ইঙ্গিত। মানুষের ভবিষ্যৎ ভালোবাসায় এবং ভালোবাসার নব নব সূত্র এবং ক্ষেত্র উদ্ভাবনের মধ্যেই কল্যাণশীল শিক্ষার অঙ্কুর সুপ্ত রয়েছে।
১৯৭৪
১. প্রাক ভাষণ – উত্তর ভূমিকা
বাঙালি মুসলমানের মন (প্রবন্ধ) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ
দুই জন সংস্কৃতিপ্রেমিক হৃদয়বান মানুষ
লুতফর রহমান সরকার
মোস্তফা কামাল
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু
.
প্রাক ভাষণ
বর্তমান গ্রন্থে স্থানপ্রাপ্ত রচনাগুলো অনধিক বার বছর সময় সীমার মধ্যে লিখিত। নাম প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। মাসিক সমকালের কোনো একটি সংখ্যায়। ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’ রচনাটি ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ’-এ স্থান পেয়েছে এবং সেজন্য ওটি লিখিত হয়েছিল। ভবিষ্যতের জন্য রচনাটি ১৯৬৯ সালের দিকে অধুনালুপ্ত ‘কণ্ঠস্বর’-এর কোনো একটি সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র লেখাটি ‘পারাপার’ নামে আরেকটি সংকলনে ১৯৭৩ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর’ রচনাটি উনিশশ বাহাত্তর সালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানোপলক্ষে লিখতে হয়েছে। পরে সেটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধটি ১৯৭২ কি ’৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেমিনারে পঠিত হয়েছিল। পরে কোথায় ছাপা হয়েছিল মনে পড়ছে না। ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ লেখাটি অধুনালুপ্ত ‘মুখপত্র’ পত্রিকায় ১৯৭০ সালের দিকে ছাপা হয়। ‘বাংলার ইতিহাস’ প্রসঙ্গে রচনাটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘অভিযান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’ শীর্ষক রচনাটি লেখা হয়েছে মাত্র মাসকয়েক আগে। এটি ‘মূলভূমি’ নামে একটি সংকলনে সবে ছাপা হলো।