.
৩.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে যে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ইউরোপ সামাজিকভাবে সংগ্রাম করে আসছিল, তা শিক্ষার দর্শনের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। যন্ত্র চালু রাখার জন্য যন্ত্রপাতিতে শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন, সুতরাং যান্ত্রিক শিক্ষা চালু হলো। এই যান্ত্রিক এবং কারিগরি শিক্ষা সামাজিকভাবে মানুষকে একপেশে করে ফেলল। অন্যদিকে কলা এবং মানববিদ্যাসমূহ যন্ত্রের প্রবর্তনের কারণে সমাজ জীবনে যে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে পুরোপুরি না হলেও বহুলাংশে ব্যর্থ হলো। তাছাড়া এই সময়ে গোটা শিক্ষা পদ্ধতি রাষ্ট্রায়ত্ব হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সৈন্য প্রয়োজন। সৈন্য হিসাবে শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করে তুলেছে । রাষ্ট্রের ডাক্তার প্রয়োজন, ডাক্তার হিসেবে শিক্ষিত করেছে। রাষ্ট্রের কারিগর, মিস্ত্রি, শ্রমিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের অনুপাতে রাষ্ট্র সবকিছু তৈরি করে নিচ্ছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ডস্বরূপ। তাই রাষ্ট্রের দর্শন এবং শিক্ষা দর্শন অনেক সময়ে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। তার ফল হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহাসকে বিকৃত করে। একটি উদাহরণ দিলেও বিষয়টি খোলাসা হবে । বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। তার আগে বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়তে হতো, ইসলামি রাষ্ট্রই হলো আদর্শ রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্রের জনক জিন্নাহ সাহেব খুব ভালমানুষ। পাকিস্তানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সবকিছু শিক্ষা দেয়ার সময় কিছু মিথ্যা বলতে হতো। বাংলাদেশে জিন্নাহ্ ভাল লোক এক কথা আর শিক্ষাবিদেরা বললেন না, শিক্ষার্থীরাও শিখবে না। তার বদলে অন্য কাউকে ভাল বলতে হবে-রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভাষা এবং সাহিত্য ইত্যাদি শিক্ষা দেয়ার সময় প্রয়োজনীয় অদলবদল করে নিতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষা ব্যবস্থার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সে রাষ্ট্র যা শিক্ষা দেয় তাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মিথ্যার মিশাল থাকেই; এই মিথ্যা মারাত্মক,মানুষের মনোবৃত্তিকে বিষিয়ে তোলার ক্ষমতা এর অপরিসীম। কোনো রাষ্ট্রই ধর্মরাজ্য নয়। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে? অথচ রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এই সময়ে একটা বড় রকমের গলদ থাকে। সেটা হলো রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সত্যকে বিকৃত করা। ইংল্যান্ডের ছাত্রেরা ইংরেজ লেখকের লেখা ইংল্যান্ডের ইতিহাস একরকম করে পড়ে, আবার ফ্রান্সের ছাত্রেরা ফরাসী লেখকের লেখা ইংল্যান্ডের ভিন্নরকম ইতিহাস পড়ে। ইংল্যান্ডের শাসক শ্রেণী ইচ্ছা করলে খুব সহজেই ফ্রান্সের জনমত ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, আবার তেমনি পারে ফ্রান্সের শাসককুল ইংরেজ ঐতিহ্য, ইংরেজি সাহিত্য ইত্যাদির অপমান করেছে ফরাসীরা। একথা অনায়াসে প্রচার করেই গোটা ইংরেজ জাতিকে যুদ্ধক্ষেত্রে তাড়িত করা সম্ভব। একইভাবে ফরাসীরাও তা পারে। এই অহেতুক জাতিগর্ব আধুনিক রাষ্ট্রগুলো নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর জেনেও রক্ষা করছে এবং তা করছে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। গত মহাযুদ্ধে হিটলার গোটা জার্মান জাতিকে জার্মান সাম্রাজ্যের নামে যতটা উদ্দীপিত করতে পেরেছিলেন, তারও চেয়ে বেশি উদ্দীপিত করেছিলেন আর্যরক্ত, আর্যজাতি ইত্যাদির ধুয়া তুলে। যুদ্ধ ঘটে যুদ্ধের প্রয়োজনে, স্বার্থের তাগিদে। সে যুদ্ধকে ভয়াবহ করে তোলার পেছনে, জাতীয় গর্ববোধ, অন্ধ ঐতিহ্যপ্রীতি ইত্যাদির অবদান সর্বাধিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ইটালি, জার্মানির নয় শুধু প্রতিটি রাষ্ট্র সচেতনায়, এই ধরনের জাতিআশ্রিত এবং ঐতিহ্যআশ্রিত নানা রকমের অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করে রেখেছে। অন্ধ বিশ্বাস থেকেই একগুঁয়ে মনোভঙ্গির উৎপত্তি । রাষ্ট্রের ভিত্তি যার উপর প্রতিষ্ঠিত সে বিশ্বাসের বিপরীত কোনো বিষয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্র চলতে দিতে পারে না। অল্প কিছুদিন আগেও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ডারউইনের আবিষ্কার পড়তে দেয়া হতো না, কেননা বাইবেলে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে যে মত প্রচলিত আছে ডারউইনের আবিষ্কারকে সত্যের কাছাকাছি স্বীকার করে নিলেও বাইবেলের মত সত্য হিসেবে আর টিকছে না। প্রাচ্যের দেশসমূহে এই বদ্ধ সংস্কারের প্রভাব অনেকগুণ বেশি। রাষ্ট্রীয় দর্শনের সঙ্গে কোনো শিক্ষণীয় বিষয়ের সামান্য গরমিল হলেই সেগুলোর পঠন-পাঠন এবং চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়। সব বিষয়ে অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যে আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষার পুরো দায়িত্ব গ্রহণ না করলে একদিকে যেমন চলে না। আবার অন্যদিকে রাষ্ট্র শিক্ষাদর্শকে রাষ্ট্রাদর্শের ছাঁচে বাঁকাতে গিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এখন একটা প্রচণ্ড রকমের সংকটের সম্মুখীন। রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার একটি বিরোধ রয়েছে। আবার প্রতিটি রাষ্ট্রের শিক্ষার আলাদা রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি মানব জাতির সহজ সম্বন্ধকে অনেকাংশে আঁটোসাঁটো করে তুলেছে। একেক জাতি মানব ইতিহাসকে একেকভাবে ব্যাখ্যা এবং বিচার করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে এর কোনোটিই হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু এই প্রিয় মিথ্যা প্রতীতি নিয়ে প্রতিটি জাতির গর্বের অন্ত নেই। এই অহেতুক ভেদবুদ্ধি মানুষে মানুষে অবারিত সম্পর্কের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে।