রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভাষা নদীর স্রোতের মতো কেউ তাতে নিজের নাম লিখে রাখতে পারে না। কিন্তু বাংলাভাষায় নিজের নাম লিখে রেখেছেন। ভাষার মতো সংস্কৃতিকেও দেশসীমা কালসীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারে না- অদলবদল রূপান্তরের মাধ্যমে ধাবমান হরিণীর মতো দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কালের বিবর্তনে জীর্ণ অংশ ঝরে যায়। নতুন প্রাণের স্পন্দনে নবাঙ্কুর গজায়। রবীন্দ্রনাথ অতীত বর্তমানের বিশ্ব সংস্কৃতির স্রোতে অবগাহন করে তার প্রাণের শিখা ছেঁকে পরিশ্রুতভাবে প্রকাশ করেছেন। আপন বাণীর মতো করে জীবন রচনা করেছেন। বিশ্বাভিসারী প্রাণের উদার আকুতি কর্মের পাষাণগলা স্রোতে ভাষায়িত করেছেন ।
আমাদের আনন্দ আমাদের গৌরব রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে মানুষের উপযোগী ভাষা হিসেবে রূপায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা মানুষ হওয়ার প্রেরণা পাই। রবীন্দ্রনাথের নাম মনে এলেই কিশোর কবি সুকান্তের সে কয়টি পঙক্তি বার বার মনে পড়ে যায়:
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে
তোমার দানের মাটি
সোনার ফসল তুলে ধরে।
১৯৬৯
শিক্ষার দর্শন
ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে শিক্ষার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল অতীন্দ্রিয়বাদে প্রোথিত । মানুষ জানবে কেন? বুঝবে কেন? জ্ঞান লাভ করবে কেন? এই সবগুলো কেনর জবাব প্রাচীন জগৎ দিয়েছে– কোনো এক অলৌকিক সত্তায় তাকে বিশ্বাসী হতে হবে। যেহেতু মানুষের মন চঞ্চল, ইন্দ্রিয় অসংযত, তাই তাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে দৈনন্দিন শৃঙ্খলার মাধ্যমে এই বিশ্বাসকে চিত্তে চেতনায় স্থির করতে হবে, কোথাও তাকে সকল কিছু সমর্পণ করতে হবে। এই সমর্পণের পাত্রটি কোনো যুগে কোনো সমাজে বহু দেবতা, কোনো সমাজে এক আল্লাহ, কোনো সমাজে অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য জন্মান্তরবাদ। একটি শৃঙ্খলার মাধ্যমে একটি কিংবা বহু বিদেহী সত্তার প্রতি স্থির বিশ্বাসী করে তোলাই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর শিক্ষাদর্শনের মূল কথা।
প্লেটো গ্রিসে গার্ডিয়ানদের যে শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পরম সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি। তিনি মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন পরম সত্তার বিষয়ের জ্ঞানের বলেই মানুষের সুস্থ সমাজ সৃজন সম্ভব। প্রাচীন ভারতে ব্রহ্ম জ্ঞানকে ধরা হতো সকল জ্ঞানের কাণ্ড- আর সব জ্ঞান ডালপালাবিশেষ। বৌদ্ধযুগে শিক্ষা বলতে বোঝাতো নির্বাণের শিক্ষা। ইসলামিক জগতে কোরআনে অখণ্ড আস্থা স্থাপন এবং পরকাল-পরলোকে নির্দ্বন্দ্বে বিশ্বাস করার যে শিক্ষা দেয়া হতো তাই আদর্শ শিক্ষা বলে বিবেচিত হতো। মধ্যযুগের খ্রিস্টান ইউরোপের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তো ছিল মা মেরীর পুত্র যীশুর ঈশ্বরের সন্তানত্বে এবং বাইবেলের অলৌকিকত্বের প্রতি কোনোরকমের প্রতিবাদহীন অন্ধ আনুগত্যের এক ‘মৌমাছি চক্র’।
আবার সে সকল মানুষকে অবতার পয়গম্বর সম্মান দেয়া হয় এবং যারা মনুষ্য জাতির শিক্ষক বলে পরিগণিত হয়ে আসছেন, তাদের সকলের বিষয়ে একটি নিরেট সত্য, তারা পরমতত্ত্বজ্ঞানী এবং একভাবে না একভাবে পরম সত্তার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন বলা হয়ে থাকে। মনুষ্য জাতির শিক্ষক। এই পয়গম্বর-অবতারদের বিষয়ে আরো একটি সাধারণ সত্য, তারা পতিতপাবন বা দরিদ্রজনের বন্ধু বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। পরমেশ্বর-বিষয়ক জ্ঞান দিয়ে তারা দরিদ্র জনগণের উপকার করেছেন । উপকার করেছেন সংশয়ের স্থলে বিশ্বাস দিয়ে এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়ে।
সুতরাং লোকাতীত ইন্দ্রিয়াতীত সত্তায় বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতাই হলো প্রাচীন জগতের শিক্ষা দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রিসে তার এক রূপ, ভারতে এক রূপ, চীনে এক রূপ এবং আরবে আরেক রূপ। মানুষের কেজো শিক্ষাকে নেহায়েত মামুলি ব্যাপার ধরে নেয়া হতো। এমনকি যে সকল বিদ্যা এবং তত্ত্বজ্ঞান আহরণে রীতিমতো সূক্ষ্মদর্শীতার প্রয়োজন তাও মনে করা হতো দেবতা কিংবা আল্লাহর কৃপাতেই সম্ভব হচ্ছে। মানুষের হাত পা চালানো মগজ মন খাটানোর প্রক্রিয়া আয়ত্ত করাকে কখনো অভিজাত শিক্ষার পর্যায়ে স্থান দেয়া হয়নি। মানব শিশুর সঙ্গে পশু শিশুর প্রভেদ স্বল্প । মানুষ যেমন খায় দায়, ঘুমোয়- পশুও ওসব কাজ করে। সুতরাং কোনো দাম নেই। যদিও বা কখনো মানুষের মন মগজের ভূমিকা স্বীকার করা হয়েছে, তাও হয়েছে এ কারণে যে দেবতার মূর্তি নির্মাণে ওগুলো কাজে আসে, আল্লাহর মহিমা কীর্তনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ও সকল কর্ম । প্রাচীন পৃথিবীর ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর মানুষের জীবনধারণ একভাবে না একভাবে দৈবের উপর নির্ভরশীল। তাই তার জৈব কর্ম, জৈবসৃষ্টিও দেবকাজে নিয়োজিত হয়ে প্রশংসনীয় হয়, অমরত্ব লাভ করে। মানুষ জীব, তাকে দেবতা করে তোলা যায় এবং তা সম্ভব একমাত্র ভক্তি বিশ্বাসের বলে। কোনো রকমের প্রশ্নশীলতার স্থান নেই। তাই প্রাচীন পৃথিবীর যে শিক্ষা দর্শন, তার মূল প্রতীতিই হলো দৈবের প্রতি মানুষকে আস্থাশীল করা। দৈব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মগজের শ্রম নিয়োজিত করাতেই জীবনের সার্থকতা।
.
২.
ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে মানুষের অনেক বিষয়ের সংস্কার যখন বীজপত্রের মতো খসে গেছে এবং সমগ্র জগৎ প্রপঞ্চ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়মের অধীন, নিয়মগুলোকে অধিগত করলেই মানুষের মঙ্গল, এই বোধ ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে যখন মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে, তারপর থেকেই প্রাচীন শিক্ষা দর্শনের ভিত নড়ে ওঠে। মানুষের জাগতিক অস্তিত্ব আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক কেজো জ্ঞান এবং বিদ্যা, অধিবিদ্যার আসন দখল করে। কেজো বিদ্যার চর্চাই পৃথিবীতে অচিন্তিতপূর্ব যুগান্তর এনেছে। প্রাচীন পৃথিবীর হাড়গোড়ের উপর নতুন একটি পৃথিবীর প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। প্রাচীন শিক্ষাদর্শনের নিরিখে ছিল মানুষের সঙ্গে পরম সত্তার সম্পর্ক নিরূপণ । কিন্তু নতুন শিক্ষাদর্শনের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ালো, মানুষে মানুষে যে সামাজিক সম্পর্ক তার প্রকৃত ভিত্তি নির্ণয়। পাশাপাশি প্রাচীন শিক্ষাদর্শনও বেঁচে রইল, কিন্তু তার দাপট অবশিষ্ট রইল না, বেঁচে রইল গাছের মরা ডালের মতো হয়ে। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে ধর্মগুরু যে কারণে পতিতপাবন বা দরিদ্রজনের বন্ধু বলে খ্যাত হয়েছেন, মানুষের প্রতিটি বৃত্তির বিশ্লেষণ করে, পরিবেশ বিচার করে মানুষে মানুষে যে সহজ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তার স্থান অধিকার করল নানা ধরনের মানবিক বিদ্যা। বস্তুত একজন বিশ্বাসী মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে যে ধরনের নির্মল আনন্দ অনুভব করেন, একজন ধর্মবিশ্বাসহীন মানুষ উন্নত সাহিত্য পাঠেও একই ধরনের আনন্দ পেয়ে থাকেন।