অনুকরণ করব না, নিজেদের সৃষ্টিশক্তি বিকশিত করে তুলব। আমরা আমাদের মতো করে কাব্য লিখব, সাহিত্য করব, ইতিহাস সাধনা করব, দর্শন চর্চা করব, বিজ্ঞানের চর্চায় মন দেব। এক কথায় পৃথিবীর সমাজ বিপ্লবগুলোর এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসের সারাৎসার মন্থন করে, প্রয়োজনীয় শ্রম, ত্যাগ এবং তিতিক্ষা সয়ে সবকিছু সম্মিলিত জীবনধারার অনুকূল করে গড়ে তুলব। মেঘনা পদ্মা-বিধৌত এই পাললিক ভূমিতে বাংলার সংস্কৃতি বাঙালির ঐতিহ্যে নতুন রক্ত মুকুল মেলবে। এই বাংলাদেশে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার ফসল আকাশ স্পর্শ করবে। সত্য ভাবার, সত্য বলার এবং সত্য আবিষ্কার করার কত বলিষ্ঠ চিত্তের প্রয়োজন আজ সব চাইতে বেশি। মিথ্যার সঙ্গে যারা আপোস করে কথায় কথায়, তাদের দিয়ে একটি জাতির মোড় ফেরানো যায় না। আমাদের জ্ঞানী-গুণী এবং বিদ্বজ্জনমণ্ডলী পরম নির্ভয়ে সত্য আবিষ্কারে স্বাধীনভাবে মন দিলে তাদের সাধনার মধ্য থেকেই জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আজকে মনের সে স্বাধীনতা চাই এবং চাই সে সাহসিকতা। দাসসুলভ মনোবৃত্তি দিয়ে কখনো একটি স্বাধীন জাতির চিত্তবৃত্তিতে বেগ জাগানো যায় না। প্রকৃত মানসিক স্বাধীনতা এবং দুর্মর সত্য অন্বেষাই বাঙালির প্রতিটি ভাবুককে ভাবিত করুক, প্রতিটি কর্মীকে কর্মক্ষেত্রে তাড়িত করুক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভাষা আন্দোলনের শহীদদের অম্লান স্মৃতি বুকে নিয়ে এটাই কামনা করছি।
আমাদের নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিভূমি ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র । গণতন্ত্রের দাবিতে উপনিবেশবাদী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা গত তেইশ বছর ধরে কঠোর কঠিন মরণপণ সংগ্রাম করে আসছি। সমাজতন্ত্র আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীভূত করার প্রাগ্রসর দাবি। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সভ্য মানুষ হিসেবে বসবাস করার প্রাথমিক অভিজ্ঞানপত্র। এগুলো বাইরের কোনো দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। আমাদের সামাজিক জীবনের বাস্তব দাবি থেকেই এগুলোর উৎপত্তি। যারা সমাজতন্ত্রের জন্য লিখবেন, ভাববেন, যারা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইবেন এবং যারা সাম্প্রদায়িকতার রূপ ব্যাধিকে সমূলে উৎপাটিত করে সুন্দর সুসভ্য মানুষদের একটি সমাজ এই বাংলাদেশে কায়েম করার জন্য সমস্ত মানুষের হয়ে চিন্তা করবেন তাদের সে স্বাধীনতা যেন থাকে। এই গ্যারান্টি আমরা আজ সরকারের নিকট নিশ্চিতভাবে চাই, এই অধিকার আমাদের জন্মগত অধিকার। আমরা মনে করছি যে যুগের অবসান হয়েছে যখন আবদুল মোনেম খানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ধমক দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং গীতাঞ্জলী রচনার নির্দেশ দিতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে একটি অসভ্য, অন্ধকার যুগের অবসানকালে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে আজ জয়ধ্বনি করছি।
বল ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নব যুগ ঐ এল ঐ
সমস্ত বর্বর চেতনা, চিন্তা এবং অশালীন মনোবৃত্তির অবসান হোক।
১৯৭২
বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে
বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে
‘বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালী বাঁচিবে না’
এই মন্তব্য করেছিলেন শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তেমন একখানি ইতিহাস লেখা তারও পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। বাধা ছিল অনেক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক। এ চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে বাঙালির ঠিকুজী কুলজী আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরা অসম্ভব ছিল । আজকের দিনে বাঙালি সমাজের কোলঘেঁষা আত্ম-অপরিচিতির অন্ধকার অনেকটা কেটেছে, সংস্কারের জটাজালের নাগপাশ অনেক বেশি আলগা হয়ে পড়েছে। বাঙালি জনগণের মন এমন অনেক ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক সত্য নির্বিবাদে মেনে নিতে রাজি হয়েছে, আগের দিনে এসব কথা শুনে বিশেষ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাও ভিরমি খেয়ে যেতেন। মন তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইতিহাসটি এখন স্বপ্নই থেকে গেছে। তথ্যের সমাবেশ করা সম্ভব, ঘটনা বর্ণনা করা যায়, রাজা-রাজড়ার নামের তালিকা দেয়া যায়। সীমিত পরিসরে অর্থনীতি সমাজনীতি শিল্প সাহিত্যের উপর ভাসা-ভাসা আলোচনা- তাও করা যায় না এমন নয়। একটি গ্রন্থ-এর সবকিছুকে কোল দিয়ে ফুলে উঠতে পারে। কিন্তু ইতিহাস হয়ে উঠবে না।
বলা হয়ে থাকে, মানুষই মানুষের ইতিহাস। এবং মানুষই মানুষের ইতিহাসের নির্মাতা। ইতিহাসে এই মানুষের পরিচয় থাকা চাই। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর মানুষেরই একটা ভগ্নাংশ। সুতরাং বিশ্বমানবতার অগ্রগতি এবং আত্মিক সম্পদের উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের মানুষও। বাঙালিকে শুধু বাংলাদেশের জারুল, গর্জন, শাল আদি বৃক্ষের মতো সৃষ্টিশীলতাবর্জিত জাতি হিসেবে বিচার করা ঐতিহাসিক সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচায়ক। আবার বিদেশী বিজাতির আরোপিত ধর্ম সংস্কৃতি বয়ে বেড়াবার ধোপার গাধা হিসেবে বাঙালিকে বিচার করাও ঐতিহাসিক সত্যের ঘোর অপলাপ। বাঙালির ইতিহাস চর্চা কখনো সহজ এবং স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত হতে পারেনি। এখানে সেখানে এক আধটু প্রয়াস দৃষ্টিগোচর হয় মাত্র। ইতিহাসকারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা আপনাপন যুগচেতনার প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র। না হয় দু-একজন দু-এক পা এগিয়েছিলেন। এখানে প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের একটি উক্তি স্মর্তব্য, ‘বাঙ্গালী গড়ে ওঠেনি, ঢালাই হয়েছে’। বাঙালি সমাজের কোন অংশ ঢালাই হয়েছে সে বিষয়ে চৌধুরী মহাশয় অধিক কিছু না বললেও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ধরে নেয়া যায়, বিভিন্ন সময়ে রাজশক্তির আনুকূল্য করেছে যে সকল শ্রেণী তারাই ঢালাই হয়েছে, বাংলাদেশের আসল মানুষের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি। এই ঢালাই হওয়া মানুষরাই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সংস্কৃতিতে লাবণ্যের সঞ্চার করেছেন। বাঙালি মনের পরিধি বিস্তৃত করেছেন। বাংলার ইতিহাসও লিখেছেন তারাই। তার ফলে দেখা যাবে ইতিহাসে ঢালাই হওয়া মানুষদের রুচি এবং দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পেয়েছে। মানুষের সমাজের চলিষ্ণুতা যদি স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে বলতে হয় ইতিহাস শুধু অতীত ঘটনা কিংবা সাল তারিখ তাম্রলিপি বা শিলালিপির সমাহার নয়। যে মানুষ বর্তমানে বেঁচে আছে, ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে, অতীত তাদের কেমন ছিল তার আসল প্রেক্ষিত তুলে ধরাই ইতিহাস। ভবিষ্যতের একটা বাস্তব পরিকল্পনা না থাকলে প্রকৃত অতীত রহস্যের উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। কেননা প্রকৃত অতীতের উপরই সত্যিকারের ভবিষ্যতের ভিত্তি।