আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সমালোচকেরা ‘হোসেন মিয়া’র চরিত্রের যে একটা ঐতিহাসিক দূর বিস্তৃতি রয়েছে বলতে গেলে তার মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থই হয়েছেন। কাউকে এ ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত করতে দেখা যায়নি। যতটা চেনা পোশাকে দেখা দিক না কেন ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রের কোনো বাস্তবতা নেই। এ সম্পূর্ণভাবেই লেখকের মায়া সৃষ্টি। এই ‘হোসেন’কে জামা কাপড় পাল্টে ভিন্ন পরিবেশে অনায়াসে সায়েন্স ফিকশনের নায়ক করে দেয়া খুবই সহজ। পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে জীবন্ত নরনারী এবং সজীব প্রাণবান প্রাকৃতিক দৃশ্যের অন্তরালে অবাস্তবতাটুকু ঢাকা পড়েছে। সর্বোপরি মানিক বাবুর অসাধারণ শিল্প প্রতিভা ‘হোসেন মিয়াকে একান্ত বাস্তবানুগভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
১৯৭৩
রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক জীবন-সাধনার প্রতি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেললে ক্রমশ মনে এ বিশ্বাস সঞ্চারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দূরের মানুষ। তাকে ধরি ধরি ছুঁই ছুঁই মনে করলেও তিনি সম্পূর্ণভাবে ধরাছোঁয়ার অতীতই থেকে যান এবং একই কারণে দুর্বোধ্য না হলেও রবীন্দ্রনাথকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে সাধনা, নিষ্ঠা, শ্রম এবং সর্বোপরি সময়ের প্রয়োজন অপরিহার্য।
রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠকমাত্রই অবগত আছেন, রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় কড়া আলো কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সমধর্মী সূক্ষ্ম, মিহি, সর্বব্যাপ্ত ও সর্বভুক এক ধরনের চেতনায় পুষ্ট রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক অবদান। তিনি যে যুগের চৌহদ্দীতে লালিত পালিত সংবর্ধিত তার আগের কিংবা পরের যুগের বাংলা সাহিত্যে জীবনের শ্রেয়োবোধর সঙ্গে সৌন্দর্যচেতনার এমন সুনিবিড় মিলন কোথাও ঘটেনি। এ অসম্ভব একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সাধনাতেই সম্ভব হয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রধান গুণ। আবার প্রকারান্তরে দুর্বলতাও বটে। এই শ্রেয়োবোধের সঙ্গে সৌন্দর্য চেতনার সহজ স্বাভাবিক মিলন রবীন্দ্রসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। তা তাকে দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বলোকের সর্বযুগের, সর্বদেশের আপনার জন করে তুলেছে যেমন, তেমনি অন্যদিকে শিল্পের এই অতি গভীর প্রতীতি, অতি প্রসারিত জীবন-দৃষ্টি তার শিল্পকর্মের অনন্যতা কতকাংশে খর্ব করেছে। জীবনের সরু, মোটা, বঙ্কিম তীর্যক অনেকগুলো স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা রবীন্দ্রমানস মথিত করেনি, সেজন্যে তার মানসিকতার বিকাশ ঘটেছে অনেকটা ঋতু বৈচিত্রের মতো স্বাভাবিক নিয়মে। দুয়েকটা বিস্ফোরণ ছাড়া রবীন্দ্রমানসে কোনো বিপ্লব কিংবা ব্যাপক পরিবর্তন নেই। উদ্ভিদের সহনশীলতায় তিনি ক্রমাগত আলোর পানে এগিয়ে গেছেন। নদীর একনিষ্ঠ স্রোতের মতো একটি স্থির লক্ষ্যের পানে আমৃত্যু ধেয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের চেতনা।
এ অন্তঃসলিলা ধারাস্রোতের সঙ্গে আরো নানা ধারার মিলন এর গতিতে দিয়েছে বেগ, কখনো বা এসেছে বন্যা। জল কূল ছাপিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ। বিশ্বেও লেগেছে দোলা। কিন্তু মৌল ধারাটি কোথাও রুদ্ধ কিংবা ব্যাহত হয়নি। এমনকি জীবনের অন্তিম ক্ষণেও সূর্যের প্রলম্বিত রশ্মি ছটার মতো সুন্দরভাবে অন্তরের সত্য বোধটি কবিতার আকারে তার মুখ থেকে একটি আলো লাগা শিশির বিন্দুর মতো ঝরে পড়েছে।
আজীবন সুন্দরের সঙ্গে সত্যের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার দুর্মর প্রচেষ্টারই তো নাম রবীন্দ্রনাথ। এ বিষয়ে তার ঐকান্তিকতা ধর্ম প্রচারকের চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। অত্যন্ত সুকুমার সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর, শ্রদ্ধার ভারে আনত একখানা মন নিয়ে তিনি যেন প্রচারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন। কিন্তু প্রচারকের লেবাস তিনি কখনো অঙ্গে ধারণ করেননি। হৃদয়ের সত্যোপলব্ধি প্রকাশের জন্য কবিতা লিখেছেন। কবিতা লিখে তার মনে হয়েছে যা বলতে চেয়েছেন, কিছুই বলা হয়নি। গল্প লিখেছেন তাই। তার পরেও মনে হয়েছে কালির অক্ষরে প্রাণের সুবর্ণ তরঙ্গমালা যেমনভাবে উচিত তেমনভাবে বেঁধে রাখতে পারেননি। তারপরে লিখেছেন নাটক, হয়তো প্রবন্ধ। এতগুলো মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার পরেও তৃপ্তি আসেনি। শরণ নিতে হয়েছে সঙ্গীতের। দ্রাক্ষাকুঞ্জের মর্মরিত বিবাগী হাওয়ায় সমস্ত অন্ত র-প্রাণ মেলে ধরেও মনে হয়েছে অস্তিত্বের গোপন গহন অন্তঃপুরে আরো সৃষ্টির বীজ বুঝি রয়ে গেল। অস্তিত্বের গভীরে যেখানে চাপ-চাপ আঁধারের নিশুতি, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তে আদিমতার ছাপ বয়ে বেড়ায়, সেখানেও পৌঁছেছে সৌন্দর্যের ‘গন্ধহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসের’ আহ্বান। সত্যের শুভ্রস্বরূপ তায়িত জলের মতো চেতনার গভীর স্তরকেও করেছে রঞ্জিত। সেজন্য তিনি শুধু অলঙ্কার আর আলোর প্রতিমা নির্মাণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। রং, রেখা আর তুলির সাহায্যে আপন হৃদয়ের প্রতিরূপ নির্মাণের জন্য তাকে আসতে হয়েছিল চিত্রকলার বর্ণিল জগতে।
অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্যের শিখা এবং সবল কাণ্ডজ্ঞানের অঙ্কুর তার মধ্যে অতি শৈশবে জেগেছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দুটি বোধ ঘনিষ্ঠ হতে ঘনিষ্ঠ হয়ে সোনার সঙ্গে সোহাগার মতো মিশে গেছে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায় প্রচারিত ব্রাহ্মধর্মে মহর্ষির আত্যন্তিক অনুরক্তির কথা স্মরণ না রেখে রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনা করলে তা একপেশে হতে বাধ্য।