যৌনাচারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও ‘হোসেনের মতামত রীতিমতো কৌতূহলের সঞ্চার করে। বৃদ্ধ বসিরের স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে ময়নাদ্বীপের ক্ষুদ্র জনসমাজটির জনমত চঞ্চল হয়ে উঠলে লোক দেখানোর জন্য ‘হোসেন’ এনায়েতকে তিনদিন অভুক্ত বেঁধে রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাতে বসিরের স্ত্রীকে যখন এনায়েতকে স্বহস্তে ভাত খাইয়ে দিতে দেখা যায় সে খবর গোপন রাখার জন্য ‘হোসেন’ অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করে। ‘হোসেনের ঐ একই যুক্তি, বৃদ্ধ বসিরের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। অথচ তার স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে দ্বীপবাসীদের মধ্যে কথা উঠলে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও করে। কিন্তু রাতে নিজেই উদ্যোগী হয়ে এনায়েতের সঙ্গে বসিরের স্ত্রীর মিলনের বন্দোবস্ত করে দেয়। তার ফলে একটি নতুন মানুষ জন্ম নিতে পারে। ‘হোসেন মিয়া’র চোখে একেকটি নতুন মানুষ হীরা মাণিক্যের চাইতেও মূল্যবান।
.
২.
‘হোসেন মিয়া’র চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কতিপয় অসাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। যদিও সে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলে, মুন্সি মোল্লাদের মতো জামা কাপড় পরে, তথাকথিত সমাজের প্রতিষ্ঠাবানদের এড়িয়ে চলে তথাপি ‘হোসেন মিয়া বিশ্বাস, হৃদয়বৃত্তিতে এবং কল্পনায় একেবারে খাঁটি আধুনিক মানুষ। যন্ত্রবিজ্ঞানে তার বিলক্ষণ দক্ষতা আছে। বিশ্বপ্রকৃতিও যে নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ, সে নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে পারলে প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞানই ‘হোসেন মিয়াকে অকুল সমুদ্রের বুকে এমন অনুত্তেজিত, সাহসী এবং প্রত্যয়সম্পন্ন করেছে। আসলে জ্ঞানই যে শক্তি তা তার টুকরোটাকরা বাক্যালাপের মধ্যে বিরল হীরার দ্যুতির মতো ঝরে পড়েছে। যে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদে এবং প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞানের সাহায্যে একসময়ে ইউরোপীয় ভৌগোলিক অভিযাত্রীর দল আমেরিকা থেকে মেরু প্রদেশ অবধি অভিসার যাত্রা করেছিল, ‘হোসেন মিয়া’ সে কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুকেরই বঙ্গীয় সংস্করণ । অতি চেনা পোশাকে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই দেখা দিয়েছে বলে ঠিক সেরকম মনে হয় না । মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ‘হোসেন মিয়া পুরনো চেতনার স্থলে নতুন মূল্য চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ধর্ম ‘হোসেন মিয়া’র দৃষ্টিতে একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং পুরনো পৃথিবীর স্মারক চিহ্ন। তাই তার নতুন উপনিবেশে নিজের কিংবা অপরের কোনো ধর্মকেই শেকড় প্রসার করতে না দিতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ নিয়ে সে বিশেষ বাক্যালাপ করে না। কারণ সমতল ভূমির লোকেরা তার এই চূড়ান্ত মতামত সমূহকে কখনো যথার্থ বলে মেনে নেবে না। একটা হৈ চৈ পড়ে যাবে। তাতে করে তার স্বপ্নের অপমৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে । এত বুদ্ধিমান, এত দক্ষ ‘হোসেন মিয়া’ও জানে ডাঙার মানুষগুলোর আচার সংস্কারের বেড়াজালে আটকা পড়লে ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা অল্প। তাই ‘হোসেন মিয়া অজস্র অর্থের মালিক হয়েও কখনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের পথে পা বাড়ায়নি। ইচ্ছা করলে সে সামাজিক সুনাম সুখ্যাতি কিনে নিতে পারত। কিন্তু তা করতে গিয়ে হোসেনকে আটকা পড়ে থাকতে হতো এবং অচরিতার্থ থেকে যেত কবি ‘হোসেনে’র একটি নির্জন দ্বীপে একটি নতুন উপনিবেশ, একটি নতুন সভ্যতার একক স্রষ্টা হওয়ার স্বপ্ন।
সামাজিক এবং নরনারীর সম্পর্ক-বিষয়ক যে মতামত ‘হোসেন’ পোষণ করে তাতে বেঁচে থাকার বাস্তব দাবির প্রতিই পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। ভুল করেও তার মুখ দিয়ে একবার, বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না,কল্পনা দিয়ে ধরা যায় না এমন কোনো ভৌতিক বিষয় উচ্চারিত হয়নি। কি সমাজ সম্বন্ধের ক্ষেত্রে, কি নরনারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে, হোসেন মিয়ার যে মতামত তা পূর্ণ মাত্রায় প্রসারিত করলে সেগুলো যে চেহারা পাবে তা দাঁড়াবে অনেকটা ইউরোপীয় প্রয়োগবাদী দার্শনিকদের মতামতের অনুরূপ।
.
৩.
আসলে ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটিকে লেখক মানিকবাবু মানুষের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অনেকগুলো পর্যায়েরই ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। যন্ত্রবিজ্ঞানে মানুষের দীক্ষা, ভৌগোলিক আবিষ্কারের অভিযাত্রা এবং সামাজিক মানব সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োজনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত সন্তর্পণে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ‘হোসেন মিয়ার’ চরিত্রে চরিয়ে দিয়েছেন। এই তিনটি জিনিসই ইউরোপে ‘এনলাইটেন্টমেন্ট’ আন্দোলনের ফল। কোনো বাঙালির মধ্যে এই তিনটি বিষয় সচরাচর সমান পরিমাণে মিলমিশ খায় না। প্রায় তিন শতাধিক বছরের অর্জিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন একটি ভৌগোলিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রাণবান করে তোলা প্রায় অসম্ভব। জীবনে যা অসম্ভব, মানিকবাবু শিল্পে তা সম্ভব করে তুলেছেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে ‘হোসেন মিয়াকে বলতে হয় নব্য মেঘনাদ’। একটি মাত্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানব জাতির অগ্রসর অংশের চিন্তা চেতনা, জীবন অভীপ্সা। দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ভূগোল-ইতিহাসের কি পরিমাণ জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল তা অবাক বিস্ময়ে কল্পনা করার বিষয়। যুগযুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার প্রতিভূ হিসেবে ‘হোসেন’কে উপস্থাপন করেছেন বলেই সমস্ত উপন্যাসে ‘হোসেনের মনোবৃত্তিসমূহের কোনো বিকাশ নেই, রূপান্তর নেই- আগাগোড়া একরকম। রক্ত মাংসের মানুষ হলেও কোনো মানবিক অনুভূতি তার মধ্যে নেই।