‘হোসেন মিয়া’র পরিচয় এভাবে দিয়েছেন লেখক তার বাড়ি ছিল নোয়াখালী অঞ্চলে। বেশ কয়েক বছর আগে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর গ্রামে সে আসে এবং সে সময়ে জহুর মাঝির বাড়িতে আশ্রিত হিসেবেই ছিল ও অন্যান্য মাঝিদের সঙ্গে মাঝিগিরি করেই জীবিকা নির্বাহ করত। এ কয় বছরে সে বেজায় রকম ধনী হয়ে উঠেছে। এখন দাড়িতে মেহেদির রং লাগায়, ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি শরীরে চড়ায়, মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই দুনম্বরের স্ত্রীকে বিয়ে করে এনেছে। ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে জেলে পাড়ার লোকদের সঙ্গে আগের মতোই মেলামেশা করে। ধনসম্পদ হাতে এলে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠার উন্মত্ত মোহ মানুষকে পেয়ে বসে, ‘হোসেন মিয়া’র মধ্যে তার কণামাত্রও নেই। বড়লোকের সঙ্গে সে ব্যবসা করে, সমাজ করে না। আরেকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন লেখক, হোসেন মিয়া একজন স্বভাব কবি। ঘটনাচক্রে যদি হোসেনের জীবনধারা বদলে না যেত তাহলে অনায়াস কবিত্ব শক্তির বলে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন একজন সাধুপুরুষ হিসেবে পরিচিত হতে পারত। ‘লালন শাহ’, হাসান রাজার মতো তারও অনেকগুলো রচনা পল্লিগ্রামের গীতি সংগ্রহে স্থান করে নিত। আশপাশের দশগ্রামের মানুষ জাগতিক কল্যাণাকাতক্ষায় তার কবরে ভক্তিভরে মোমের প্রদীপ জ্বালাতো। কিন্তু ঘটনাচক্রে ‘হোসেন’কে অন্য জীবন বেছে নিতে হয়েছে, তাই বলে তার কবিত্ব শক্তির উৎস একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়নি। এখনো সে ইচ্ছে করলে মুখে মুখে চমৎকার গান রচনা করতে পারে। তার আত্মপ্রত্যয়ের জুড়ি নেই। তাই ‘হোসেন’ যখন বলে, খুশি হলে সে সব করতে পারে, একটুও অস্বাভাবিক শোনায় না। অপরিসীম আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন, নানাগুণে গুণান্বিত ‘হোসেন মিয়া’র আত্মসংযমেরও তুলনা নেই। কেউ তার ক্ষতি করলে শাস্তি সে দেয়, কিন্তু কখনো কোনো ব্যাপারে তাকে রাগ করতে দেখা যায়নি।
‘হোসেন মিয়া’ পাকা মাঝিও বটে। এত নির্ভাবনায় সে গভীর সমুদ্রে নৌকায় হাল ধরে বসে থাকতে পারে, পদ্মাপারের বংশ পরম্পরা মাঝিরাও ‘হোসেনে’র হেকমত দেখে চমকে যায়। সে ম্যাপ দেখে দ্বীপের অবস্থান নির্ণয় করতে জানে, রাতের তারার গতিপথ দেখে সময় কত বলতে পারে, দিক নির্ণয়ের কাজে চুম্বক ব্যবহার করতে জানে নির্ভুলভাবে। চাটগায়ে সায়েব কোম্পানির জাহাজে চাকরি করার সময় যন্ত্রপাতি চালনার বিদ্যা এত গভীর অনুরাগ নিয়ে শিক্ষা করেছে যে, ইচ্ছা করলে ‘হোসেন’ একখানি জাহাজ নিয়ে সমস্ত পৃথিবী একাকীই ঘুরে আসতে পারে।
‘হোসেন মিয়া’র বাড়ি নোয়াখালী। মাঝখানে অনেক বছর জাহাজে সে চাকরি করেছে এবং বর্তমানে পদ্মাপারের কেতুপুর গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মাঝিদের সঙ্গেই তার সমাজ।
সংকীর্ণ পৃথিবীর এই অধিবাসীরা অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন ‘হোসেন মিয়া’র সাথে ঠিক মিশতে পারে না। কিন্তু তাদেরকে তার কাছে যেতেই হয়। ‘হোসেন’ যদিও বলুক-না কেন সে হৃদয়ের মধ্যিখান থেকে তাদের পেয়ার করে, তথাপি মজ্জাগত আদিম অসহায়তার ভীতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না। যন্ত্রের মতো নিখুঁত, দেবতার মতো পারঙ্গম এবং জীন-পরীর মতো রহস্যময় ‘হোসেন মিয়া’র কথায় সায় দিলে, তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে যে একদিন অমঙ্গল এসে তাড়া করবে তারা বুঝতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়তিই এমন যে তারা যেন ‘হোসেনে’র কথায় সায় দিতে এবং তার নির্দেশ পালন করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে।
বহিরঙ্গের দিক দিয়ে দেখলে ‘হোসেন নোয়াখালী জেলার মুন্সী মোল্লা জাতীয় মুসলমান। সে মুন্সী মোল্লার মতো কথা বলে, পোশাক পরে, দাড়ি রাখে, আবার দাড়িতে নুরে মেহেদির রংও লাগায়। এ হলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরের মানুষটি ঠিক একবারে অন্যরকম। হোসেনের মধ্যে ধর্মীয় কোনো সংস্কারের সামান্য আঁচারও নেই। এ নিয়ে সে কোনো কথাই বলে না। সে শুধু বোঝে তার জন্য কোটা সুবিধার । জগৎ এবং জীবনকে সে যে দৃষ্টিতে দেখে তার সঙ্গে অন্য দশজন প্রাচ্য দেশীয় মানুষের কোনো মিল নেই।
আজিজ সাহেব প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি ময়নাদ্বীপে মসজিদ স্থাপন করে এবং হিন্দুদের জমি দেয়া বন্ধ করে তাহলে বসবাসকারী সংগ্রহের কিছুই অসুবিধা হবে না। হোসেন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। গ্রহণ না করার পেছনে কারণ হলো, মুসলমানদের জন্য যদি মসজিদ বানিয়ে দেয়, তা হলে হিন্দুদের জন্যও মন্দির বানিয়ে দিতে হবে। আর হিন্দুদের যদি সে না নিয়ে যায়, তাহলে এগার মাইল দীর্ঘ এই দ্বীপ সে কিভাবে মানুষ দিয়ে পূরণ করবে তাই হোসেনের যুক্তি হলো, মন্দির মসজিদ সব ফ্যাসাদে গিয়ে কাজ নেই। ওসব ছাড়াই চলবে ময়নাদ্বীপ। ময়নাদ্বীপ আবাদ করে বসবাস স্থাপন করার সঙ্গে মন্দির মসজিদের কোনো ব্যবহারিক সম্পর্ক নেই। তাই পরম নিশ্চিন্তে সেগুলো বাদ দিতে পারে । ময়নাদ্বীপে সে যে নতুন মানব সমাজ সৃষ্টি করতে চায় তারা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হবে, হবে নতুন বিশ্বাসে বলীয়ান, নতুন মূল্য চেতনায় সমৃদ্ধ হবে তাদের অন্তর্লোক। অতিকষ্টে যে সকল ভাঙাচোরা মানুষকে ‘হেসেন’ সংগ্রহ করে, পাত্রী ঠিক করে তাদের বিয়ে দেয়, তাদের প্রতিও ‘হোসেনে’র কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই নরনারীর মিলনে যে মানুষ মানুষী আসবে এবং ময়নাদ্বীপে বসবাস করবে তাদের প্রতিই রয়েছে তার প্রকৃত আগ্রহ। যেন ‘হোসেন’ নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন মানব সভ্যতার সৃষ্টি করতে যাচ্ছে একাকী। এই রকম একটি প্রকাণ্ড ঘটনা যার প্রয়াসের মধ্য থেকে সম্ভাবিত হয়, তাকে বিধাতা পুরুষের মতো পারঙ্গম,দুৰ্জ্জেয় এবং ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠতে হয়। স্বয়ং বিধাতাপুরুষও নাকি একজন কবি। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তার কবিতা। মানিক বাবুর ‘হোসেন মিয়া’ও একজন ক্ষুদে বিধাতাপুরুষ। সীমিত পরিসরের মধ্যে তার অসাধ্য কোনো কিছুই নেই এবং ময়নাদ্বীপ তার একটি কবিতা। একজন ভাবমুগ্ধ কবি যেমন সমস্ত প্রযত্ন প্রয়াস বিলিয়ে দিয়ে কবিতাটিকে সার্থক করে তুলতে চান, ‘হোসেন মিয়া’ও স্বপ্নের শেষ বিন্দুটি দিয়ে ময়নাদ্বীপকে, লোক কোলাহলে মুখরিত একটি কাব্যিক ভূখণ্ড হিসেবে নির্মাণ করতে চায়।