অথচ মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য এ যুদ্ধকে অবশ্যই রুখতে হবে নয় শুধু, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করতে হবে। এককভাবে কোনো জাতির শান্তি প্রচেষ্টাতে আসবে না কোনো সুফল। সমস্ত জাতি মিলে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে, সেজন্য জীবনবিনাশী সকল রকমের সংস্কার এবং বিশ্বাস উপড়ে ফেলা একান্তই প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উন্নত জাতি এবং অনুন্নত জাতি উভয়েরই সমান দায়িত্ব। সভ্যতা, সংস্কৃতি,কলকারখানা ইত্যাদিকে এমনভাবে বিকেন্দ্রিত করতে হবে, যাতে করে বিশ্বের প্রতিটি জাতি, এমনকি উপজাতি পর্যন্ত সভ্যতার প্রভায় প্রভাময় হয়ে উঠতে পারে। যন্ত্রকে সব সময়েও মানুষের দাস করে রাখতে হবে এবং সৃষ্টিশীলতাকে উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। কারণ শোধিত বিদ্বেষই সৃষ্টিশীলতা, উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে সৃষ্টিশীল চেতনাই বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়। জাতিতে জাতিতে যে প্রতিহিংসা বিরাজমান, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তার অবসান ঘটাতে হবে। মানব সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে জীবন-ঘনিষ্ঠ করে তুলতে হবে। তা ছাড়া সামরিক ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ জনকল্যাণের জন্য ব্যয় এবং একাংশ মহাশূন্য অভিযান তহবিল, মেরু অভিযান, মরু অভিযান, সাগর থেকে খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি পরিকল্পনাতে ব্যয় করলে সৃষ্টিশীলতার অভিঘাতে মানুষ নতুন মানসিকতার অধিকারী হয়ে উঠবে। ক্রমাগত সাধনা এবং সিদ্ধি যেমন পশু-মানুষকে কিয়ৎ পরিমাণে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে, তেমনি নব বিশ্ববোধে উদ্দীপ্ত, নিজেই বস্তুচেতনার অধিকারী মানুষ বিচারবুদ্ধিকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পারবে এবং যুদ্ধ করার প্রাগৈতিহাসিক বৃত্তিও ধীরে ধীরে ভুলে যাবে।
এ হয়তো কঠিন,খুবই কঠিন কাজ। কুসংস্কারের সঙ্গে আপোসকারী, রাষ্ট্রযন্ত্রের দণ্ডধর, দলীয় এবং শ্ৰেণীস্বার্থের প্রতিভূ রাষ্ট্রনায়কদের খণ্ডিত উপলব্ধি এবং লোভের কারণে পারমাণবিক বোমার আঘাতে নিহত হওয়ার চাইতে কঠিন নয় নিশ্চয়ই। ধর্ম, স্বর্গ, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদির ফসিল বিশ্বাস এবং জীবন্ত বিশ্বাসকে শল্যচিকিৎসকের মতো অস্ত্রোপচার করে চেতনা থেকে হেঁটে ফেলতে পারলেই মানবিক কল্পনা ঈর্ষার বদলে সৃষ্টিশীলতার দিকে আপনিই ধাবিত হবে।
ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সৃষ্টিশীলতার উপরই বিশ্বাস রাখতে হবে। সৃষ্টিশীলতাই মুক্তির দিশারী ।
১৯৬৭
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র
বাংলা সাহিত্যে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কোনো জুড়ি নেই। এই উপন্যাসের একটি চরিত্রে মানিকবাবু যে সুগভীর ইতিহাসবোধ, জীবন অভীপ্সা এবং মনীষার পরিচয় দিয়েছেন, বোধকরি চরিত্রসৃজনকুশলতায় তারো কোনো জুড়ি নেই। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা উঠলেই কুবের, মালা, কপিলা, রাসু, গনেশ ইত্যাকার মানুষদের মুখগুলো আপনা-আপনিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মানিক বাবু তেমন শিল্পী (বিশেষ করে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে) যা স্পর্শ করেছেন, জীবন্ত করে তুলেছেন। ক্ষিপ্র টানে একেকটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র প্রমত্তা পদ্মা থেকে শুরু করে, প্রাকৃতিক তাণ্ডব, ঝড়, বন্যা, সমুদ্রের ভয়ংকর বিস্তার, এমনকি সে আকুরঠাকুরের গ্রামের শ্যামাদাসের বাড়ির গম্ভীর পাঁঠাটি পর্যন্ত আশ্চর্য রকম জীবন্ত। যে নৈসর্গিক পটভূমিকায় জীবন সংগ্রামে কাতর মানুষগুলোকে তিনি স্থাপন করেছেন সেই নিসর্গ যেমন ভীষণে সুন্দরে জীবন্ত, তেমনি জীবন্ত বিচিত্র আবেগের মানুষগুলো। কেউ বাড়তি নয়, কোনো ঘটনা বাহুল্য নয়, কোনো দৃশ্যপট অতিরিক্ত নয়। তাই উপন্যাসটির কথা উঠলেই সবকিছু মনে পড়ে যায় এবং সব মিলিয়েই উপন্যাসটি। যার যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকু আয়তনের মধ্যেই লাগসইভাবে বসে গেছে। কুবের-মালা-কপিলা-রাসু এসব চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনের মধ্যে যে হৃদয় ভাবনার উৎসার হয়েছে, গভীর চিন্তাটি পর্যন্ত পরিবেশের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সে উপস্থাপনার বাস্তবতা এবং শিল্প সৌকর্য নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব।
উপস্থিত মুহূর্তে আমরা তার ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটির প্রতি একটু অভিনিবেশ সহকারে তাকাবার চেষ্টা করছি। বেবাক বাংলা সাহিত্যে এমন আশ্চর্য চরিত্র আর কোনো শিল্পী সৃষ্টি করেছেন কিনা সন্দেহ। শুধু অন্তদৃষ্টি, শুধু জীবনবোধ কিংবা লেখকসুলভ নির্লিপ্ততা, লেখার রাজনৈতিক সামাজিক দর্শন অথবা মানবচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই এরকম একটা চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না। আরো অধিক কিছুর প্রয়োজন।
সমস্ত উপন্যাসে যদিও ‘হোসেন মিয়া’র উপস্থিতি অধিক নয়, তবু ‘হোসেন মিয়া’ই উপন্যাসটির প্রাণ। কিন্তু তাই বলে ‘হোসেন’ উপন্যাসটির নায়ক নয়। নায়কের যে আবেগ থাকে, দুর্বলতা থাকে, ‘হোসেনে’র চরিত্রে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ইলিয়াড মহাকাব্যে দেবরাজ জিউসের নির্দেশে যেমন সবকিছু একের পর এক ঘটে যাচ্ছে- বিজয়ী-বিজিত, হত এবং হন্তা শুধু নিমিত্তমাত্র, সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই মহাইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন দেবতার চূড়ান্ত ইচ্ছারই বিজয় সূচিত হয়েছে; ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে পাদপ্রদীপের একটু পেছনে দণ্ডায়মান মিঠেমিঠে বুলি এবং গুছিগুছি দাড়িবিশিষ্ট এই শান্ত একেবারে অনুত্তেজিত মানুষটিও সেরকম শক্তির অধিকারী। তার প্রকাণ্ড ইচ্ছাশক্তির প্রবল বাধ্যবাধকতা পদ্মার তীরবর্তী জেলে সমাজে অত্যন্ত সক্রিয়, তারা কেউ সে নিগড় ছিন্ন করতে পারে না। এই মহাস্বাপ্লিকের স্বপ্ন সফল করার জন্য আনন্দবেদনা স্পন্দিত প্রেম ভালোবাসা কল্লোলিত অন্তর নিয়েই স্বেচ্ছায় ‘হোসেন মিয়া’র কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। অথবা তাদের বেঁচে থাকবার গভীর আকাঙ্ক্ষাই তাদেরকে বাধ্য করে হোসেন মিয়ার কাছে যেতে। পদ্মা পারের এই এক টুকরো পৃথিবী, যেখানে জেলে সমাজের বসবাস, মায়ামমতা, ঝগড়াবিবাদ এবং প্রাণধারণের সমূহ আর্তি গভীর করুণ সুরে বেজে ওঠে, তা যখন কোনো কারণে দৃষ্টির সীমানা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়, বিশাল পৃথিবীর অন্য কোনো স্থান, অন্য কোনো জনপদ তাদের দৃষ্টিতে নিবাসভূমি হিসেবে ভেসে ওঠে না; জঙ্গলাকীর্ণ, বাঘ সিংহে ভরা, লোনাজলবেষ্টিত ঊষর অনুর্বর ময়নাদ্বীপের ছবিই চোখে চোখে দৃশ্যমান হয়। সেখানে যাবার দুঃস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং শেষ পর্যন্ত যেতেও হয়। হোসেন মিয়া এই ময়নাদ্বীপের রাজা এবং আবিষ্কারক দুই-ই।