স্বভাবতই মানুষ কল্যাণ চায়। অপরের কল্যাণ চাইবার মতো উদারতা এবং দূরদৃষ্টি অনেকের নেই, এ কথা সত্য। কিন্তু মানুষ নিজের কল্যাণ, নিজের দেশের, নিজের জাতির,নিজের দলের কল্যাণ অবশ্যই চায়। এমনকি যুদ্ধ করার পেছনেও থাকে মানুষের আত্মকল্যাণবোধ। এ আত্মকল্যাণবোধের তাড়নায় জাতিসমূহ সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করেছে, জনসংখ্যার একাংশকে উপোস রেখে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে। অতীতে জাতিসমূহ উকট আত্মকল্যাণবোধের তাগিদেই যুদ্ধ করেছে এবং বর্তমানেও সে একই বোধের উগ্র উন্মাদনায় যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের ইতিহাস মানুষের খণ্ডিত কল্যাণবোধের ইতিহাস। আদিতে গোত্রদেবতাদের নামে, পরে ধর্মের নামে, তারপরে দেশের নামে, নীতির নামে, দর্শনের নামে,একটানা মানুষে মানুষে সংঘাত চলেই আসছে। অতীত ইতিহাসের রক্তমাখা অধ্যায়গুলোর দিকে তাকালে মানুষের ভেদবুদ্ধিজনিত অজ্ঞতা স্পষ্টতই চোখে পড়ে। কি ঠুনকো কারণেই না একেকটি জাতি সংগ্রাম করেছে। যে দেবতা, ধর্ম, নীতি, দর্শন এবং সাম্রাজ্যের জন্য অপরের রক্ত নিয়েছে এবং নিজের রক্ত ঢেলেছে মানুষ, তার প্রায় সবগুলো আজকে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। পূর্বযুগের বিশ্বাস, নীতি, মূল্যবোধ, দর্শন এবং জীবনচেতনা সম্পূর্ণভাবে পাল্টেছে। মানুষের সাধনা, শ্রম এবং প্রতিভার স্নিগ্ধ সাহস বিশ্বের এবং জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে অনুপ্রাণিত রয়েছে। তার ফলে পুরনো চিন্তার খাত বদলে নতুন প্রবাহে ধাবিত হয়েছে মানুষের চেতনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিটলার জার্মান জাতিকে আর্য সাম্রাজ্য এবং মুসোলিনী ইটালিয়ানদের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার উন্মাদনায় মাতাল করতে পেরেছিল বলেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। আজকের দিনে যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক বিবেকসম্পন্ন জার্মান কিংবা ইটালীয়ান হিটলার মুসোলিনীকে শুধু উন্মাদ ছাড়া কিছুই মনে করবে না। মানবজাতির লিখিত এবং অলিখিত ইতিহাসের চার ভাগের তিন ভাগ এমনি পাগলামোতে ঠাসা। তাতে করে বিঘ্নিত হয়েছে মানুষের বিকাশ। সুস্থ সক্ষম ব্যক্তিরা সমরক্ষেত্রে নিহত হয়েছে, জাতিতে জাতিতে সহযোগিতার পথ রুদ্ধ হয়েছে, একপেশেভাবে বেড়েছে বুদ্ধি, বিজ্ঞানীদের সাধনায় এসেছে বাধা, মানবতাবাদীরা নির্যাতিত হয়েছে। যে-কোনো নরহন্তা কলেকৌশলে অথবা ছলে-বলে আপন দলের লোকদের পশুবলে বলীয়ান করতে পেরেছে, তারাই আল্লাহ্ কিংবা ধর্ম, সাম্রাজ্য অথবা স্বদেশ ইত্যাদির নামে প্রতিবেশী দেশের উপর বর্বর আক্রমণ চালিয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ঘাতকেরাই বিজয়ী অথবা বীর হিসেবে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। মানুষের উপলব্ধিতে পূর্ণতা যখন আসবে, তখন এ সকল বীরপুরুষেরা ঠ্যাং-ভাঙা টোটেম দেবতার মতো শ্রদ্ধার আসন থেকে ছিটকে পড়বে। অবশ্য ইতিহাস বিচারের নিরিখটাও তখন পাল্টাবে ।
মানুষের ইতিহাসের আরো একটি দিক আছে। সে হলো-বিজ্ঞান, শিল্প, কলা এবং দর্শনের দিক। এতে কোনো জাতির সিলমোহর নেই। এক জাতির সুচেতনার সঙ্গে মিশেছে আরেক জাতির নির্মাণবুদ্ধি কলার সঙ্গে দর্শন, এদেশের বিজ্ঞান ও দেশে গিয়ে তরঙ্গ তুলেছে। সামগ্রিকভাবে মানুষের সৃষ্টিশীলতার বিচিত্র সংক্রমণেই সভ্যতা ষোলকলায় পুষ্টি লাভ করেছে। মৈত্রীভাবনা মানুষে মানুষে সহযোগিতার পথ প্রসারিত করেছে, এক জাতির চিন্তার অভিঘাতে আরেক জাতির কুসংস্কার ঝরাপাতার মতো ঝরে পড়েছে। ভারতে-চীনে, ভারতে-ইরানে, ইরানে-মিশরে, মিশরে-গ্রিসে, গ্রিসে-রোমে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে মনে মনে যে সহযোগিতার ফল তাই আধুনিক বিশ্ববোধ। বুদ্ধির সহযোগিতায় আধুনিক দর্শন এবং বস্তুবিজ্ঞানের সহযোগিতায় আধুনিক বিশ্বদৃষ্টি বিকশিত হয়েছে। আধুনিক জগতের রূপায়ণে আট কি দশজন মৌলিক আবিষ্কারকের দান অসামান্য হলেও বহু দেশের, বহু যুগের চিন্তা, মনন এবং আবিষ্কারের ফসল মন্থন করতে পেরেছেন বলেই তারা মানুষের বাস্তব সিদ্ধিকে আরো এক কি দুধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে সভ্যতার সৌরভ বলতে যা বুঝি আমরা, সে হলো মাত্র গুটিকয় মানুষের মন মগজ খোঁচানো অন্বেষা,জবাব এবং হৃদয়ে হৃদয়ে সহযোগিতার সুফল। অতীতে এ সহযোগিতার পথ বহুলভাবে উন্মুক্ত ছিল না। দেশাভিমান, জাত্যাভিমান, ঐতিহ্যাভিমান, ঐশ্বর্যাভিমান পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটি জাতিই নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করেছে, জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য যখনই অপরের সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, অপরকে দাসে পরিণত করে তার শ্রম, অর্থ, ফসল আত্মসাৎ করা ছাড়া আর কোনো মহত্তর পদ্ধতির কথা চিন্তা করতে পারেনি। মজার কথা হলো, অপরকে ক্রীতদাস বানিয়ে, তাকে পশুর মতো খাঁটিয়ে, তার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে দেবতার বিজয় ঘোষণা করেছে। কিন্তু অবাধে মানুষের সৃষ্টিশীলতা, জাতির সঙ্গে জাতির যদি মেশামেশি হতো অতীতে, তাহলে এতদিনে পৃথিবীর মানুষ মহাশূন্যের অনেকগুলো গ্রহে হয়তো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেই ফেলত।
বিগত যুগে মানুষ যা উপলব্ধি করতে পারেনি, এ যুগে মানুষের তা হৃদয়ঙ্গম করার সময় এসে গেছে। কেননা মানুষের সৃষ্টিশীলতা এবং পাশবিক প্রবৃত্তি এখন পরস্পরের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বীর বেশে দণ্ডায়মান। মানুষকেই পছন্দ করতে হবে দুটির একটি। হয়তো সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে সকল মানুষকে, পৃথিবীর মাটিতে দিতে হবে অধিকার। উন্নত জাতিসমূহ অনুন্নত জাতিগুলোকে তাদের বাস্তবসিদ্ধি এবং মননের সমৃদ্ধির অংশীদার করে তুলতে হবে। এ না হলে দেশ, ধর্ম, নীতি, দর্শন, সম্প্রদায় ইত্যাদি কতক গালভরা সুন্দর শব্দের অন্তরাল থেকে পাশবিক প্রবৃত্তি আপনাআপনি প্রকটিত হয়ে পড়বে। তা যদি হয়, সহজেই ধরে নেয়া যায়, পৃথিবীতে মানুষের দিন ফুরিয়ে এল। পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাষ্ট্রগুলোও ধীরে ধীরে এ সত্য উপলব্ধি করছে। এক জাতি ও এক বিশ্বের চেতনা দেশে দেশে আলোড়নের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। শুভবুদ্ধি এবং কল্যাণচেতনার নিরিখে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উত্তাপ প্রশমিত করা সম্ভব, কিন্তু বর্তমানেও পৃথিবীর জাতিসমূহের চালিকাশক্তির পেছনে যতটুকু রয়েছে কুসংস্কার ততটুকু সুচেতনা নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতি অনুন্নত জাতির সম্পদ লুট করছে, বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য অটুট রাখার জন্য সামরিক ঘাঁটির প্রতিষ্ঠা করছে এক শিবির, আরেক শিবিরও পাল্টা সামরিক জোট গঠন করছে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সরকারগুলো আপনাপন দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশকে সকল রকমের সুযোগ হতে বঞ্চিত করছে। এ বঞ্চিতদের দল জেগে ওঠে যদি কোনোদিন সিংহাসন ধরে হেঁচকা টান দেয়, এ ভয়ে সবসময় যুদ্ধের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখেছে। যখনই দেশে তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখা দেয়, সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশী শত্রুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম, ধর্মপ্রেম ইত্যাদির নামে পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন এ সবের মাধ্যমে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে বিজাতি বিদেশীর বিরুদ্ধে, প্রচার অভিযান চালিয়ে জনসাধারণের মন এমনভাবে বিষিয়ে দেয় যে, জাতিতে জাতিতে সহযোগিতার কথা বলে যারা, তাদেরকে অতি সহজে দেশদ্রোহী জাতিদ্রোহী এবং ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করতে ক্ষমতাসীন দলের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না। জনসাধারণের সংগঠিত কুসংস্কারই রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুসংস্কারের সঙ্গে আপোস করে যারা ক্ষমতা দখল করে, তারা সমগ্র জাতিকে নরহত্যার প্রচণ্ড উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখে। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই কোনো। ফলে জাতিতে জাতিতে বৈরীতার রূপ তীব্র হয়ে উঠছে। বিশ্বে বিষফেঁড়ার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য যারা কায়েম রাখতে চায়, এসকল বিষফোঁড়া রগড়ে রগড়ে ক্ষতকে আরো দগদগে করে তুলছে। বাণিজ্যের প্রয়োজনে সভ্যতাকে শুধু মুষ্টিমেয় শহরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, মানুষকে যন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত রেখে যন্ত্রের দাস করেছে। স্তরের পর স্তর কুসংস্কার, তার উপর রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রনায়কেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুক্তিহীন কুসংস্কারকেই লালন করেন অথবা করতে বাধ্য হন। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে তৃতীয় মহাযুদ্ধকে প্রতিহত করার সকল রকম উপায় ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হবে।