১৯৭০
ভবিষ্যতের ভাবনা
মানুষ গড়েছে সভ্যতা। রেশম কীট যেমন করে তন্ময় সাধনায় তৈরি করে গুটি। গত, গত যুগের মানুষের শ্রমের ভাষা, ধ্যানের ধ্বনি, বীর্যের ব্যঞ্জনা, আমাদের তন্ত্রীতে দোল দিয়েছে, জাগিয়ে তুলেছে ভাবনার সুবর্ণ লহরী। বিজ্ঞানের দীপ্তি, দর্শনের আলোক, সাহিত্যের মৈত্রী এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের সুচারু ব্যবস্থা আমাদের যুগকে করেছে মহীয়ান, মনীষাকে প্রখর এবং বুদ্ধিকে দিয়েছে মহাপৃথিবীর উদার দিগন্তে মুক্তি। নিজেকে এমন বিচিত্রভাবে জানার প্রয়াস আর কখনো দেখা যায়নি মানুষের ইতিহাসে। মানুষের বস্তুসঞ্জাত কল্পনা বস্তুর অন্তর থেকেই ঠিকরে বের করে এনেছে অপরিসীম শক্তিসম্পন্ন পরমাণু কণা। বস্তুর সঙ্গে পরিচয়, বস্তুর শক্তিকে আয়ত্ত করার ইতিহাসই সভ্যতার ইতিহাস। তাতে প্রবল সৃষ্টিশীল আরেকটা জাগরণ কখন ঘটবে? যার অভিঘাতে মুছে যাবে মানুষের চোখের ঘোর। শুদ্ধরূপে বস্তুর স্বরূপ উপলব্ধি করে জীবনের সঙ্গে বস্তুর সার্থক মিতালী পাতাতে সক্ষম হবে মানুষ। মানুষে মানুষে সহজ সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা করে, চিন্তাকে আরো সূক্ষ্ম, আরো বস্তুনিষ্ঠ করার ভাবঘন মৈত্রীতে যুগের হৃৎপিণ্ড চঞ্চল হয়ে উঠেছে এই বুঝি ফেটে পড়ে।
পূর্বপুরুষের সৃষ্টিশীল চেতনার স্পর্শ আমাদের চেতনাতে এসেছে হীরকের জ্যোতি আর সৃষ্টিশীলতায় জেগেছে নাড়া খাওয়া অনুরণন। একইভাবে উত্তর পুরুষ হিসেবে তাদের অন্তরলালিত তমিস্রারও আমরা উত্তরাধিকারী। আলো টানছে সামনে, অন্ধকার পেছনে। এক দিকচিহ্নহীন গোলকধাঁধার বাসিন্দা এ যুগের মানুষ। সভ্যতার মহীরুহে কি নতুন মুকুল ধরবে? নাকি প্রকৃতির স্নেহ বন্ধন থেকে মূলশুদ্ধ খসে পড়বে প্রবালদ্বীপের মতো মানুষের গড়া এ সভ্যতা। তা আমরা জানিনে। জানিনে বলেই ভয়, জানিনে বলেই সংশয়। উত্তরণের পথ হয়তো আছে, কিন্তু আনাড়ির চোখে ধরা পড়ার কথা নয়। বর্তমান মুহূর্তে মানুষের অসহায়তার দিকটাই প্রবল হয়ে চোখে পড়ছে। ইতিহাসের প্রত্যেক উত্তরণকালে অসহায়তাই যুগিয়েছে। সাহস, প্রেরণা দিয়েছে বাস্তবের মুখোমুখি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে এবং মৈত্রী ভাবনায় উর্বরা করেছে মন। কিন্তু প্রত্যাসন্ন কাল সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলবার যো নেই। কারণ যে কঠিন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সংকটকালে লড়েছে মানুষ, তাই-ই এখন টলটলায়মান। এখন প্রতিটি জাতি প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। পারস্পরিক হিংসাবিদ্বেষের গোড়ায় জল ঢালতে গিয়ে সারা শরীর অস্ত্রময় রণোন্মাদ ডাইনোসরকুল যেমন ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্মূল হয়েছে, মানবকুলেরও তেমনি একটা সামগ্রিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বৈকি!
ইতিহাসের অতীত থেকে মানুষ যুদ্ধ করে আসছে। কিন্তু পূর্বের যুদ্ধসমূহের ব্যাপ্তি ছিল সীমিত, বিশেষ জাতি এবং বিশেষ দেশের সীমানায়। তখনো মারণাস্ত্রের ব্যবহার হতো। দেদার মানুষ যেত মারা। বিধবা এবং পুত্রহীনা জননীর করুণ বিলাপ বাতাসে ধ্বনিত হতো। সমগ্র মানবজাতির বুকে তীব্র হলাহল মেশানো এতবড় একটা শক্তিশেল হয়ে কখনো দেখা দেয়নি যুদ্ধ। এরপর যদি যুদ্ধ লাগে অবস্থা কি হবে? সভ্যতার ভিত্তিমূল ধসে যাবে কিনা, প্রতিটি শান্তিপ্রিয় পৃথিবীবাসীর চোখে একটা বেদনার্ত জিজ্ঞাসার চিহ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। মানুষের হাতে যে পরিমাণ অস্ত্র জমা আছে, শুধু সে-সবের সদ্ব্যবহার করলে আমাদের পৃথিবীর মতো কয়েকটি গ্রহকে জীবজন্তুহীন করে ফেলা মোটেও অসম্ভব নয়। যুদ্ধ যে লাগবে না, এমন কথা কে বলতে পারে? বিজ্ঞান এবং কারিগরিবিদ্যায় উন্নত জাতিসমূহের সঙ্গে সঙ্গে জাগরণশীল জাতিগুলোও প্রতিরক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলছে, জনসংখ্যর একাংশকে উপোস রেখে অস্ত্র ক্রয় করছে। কারিগরিবিদ্যা এবং বিজ্ঞানে অল্প-স্বল্প দক্ষতা অর্জন করেছে, এমন অনেক জাতি রাতারাতি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য কাঁপালিক সাধনায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের দিকে দিকে জমছে প্রচণ্ড উত্তাপ। স্নায়ুযুদ্ধের তলায় চাপা পড়ছে শুভবুদ্ধি। কোনো কোনো অঞ্চলের বিষধোয়া চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না ধোয়ার মধ্য থেকে আগুন জ্বলে ওঠার পুরোপুরি সম্ভাবনা বর্তমান। যদি তাই হয় সমগ্র জাতির জনসাধারণের কল্পনাকে খাট করে অথবা জাতিকে উপোস রেখে, হিংসা প্রতিহিংসার ওমে’তা দেয়া যে বোমাগুলো কোটি কোটি মুদ্রা ব্যয় করে তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোর কি ব্যবহার হবে না? যদি না হয়,অপর্যাপ্ত অর্থ এবং মানুষের এযাবৎকালের বস্তুবীক্ষণের সবচাইতে সূক্ষ্ম সিদ্ধি যাতে মিশেছে সে মহামূল্য পারমাণবিক বোমা ইত্যাদি দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রনায়কেরা কি ব্রেকফাস্ট করবেন?
একদিকে গ্রহান্তরের শ্যামের বাঁশী, আরেকদিকে বিনাশের সর্বনাশা ইঙ্গিত । দুমেরুর কোন্ দিকে তাকাবে মানুষ? প্রত্যাশা নিয়ে অভাবনীয় সাফল্যের চূড়োর পানে তাকাতে দোষ নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, পারমাণবিক অস্ত্র ছোঁড়াছুঁড়ি হয়ে যায়, তাহলে তো সব কিছুর ইতি। আবার নৈরাশ্যবাদের সঙ্গে প্রেম জমিয়ে ধীরে ধীরে অজগরের শ্বাসের টানে ছুটে চলা ভয়ার্ত হরিণের মতো এগিয়েও একই পরিণতিতে পৌঁছানো যায়। সুতরাং বিনা আয়াসে ভাবা যায়, রেশম কীটের মতো নিজের গড়া সভ্যতার আবেষ্টনীর মধ্যে, নিজেরই উদ্ভাবনী শক্তির তাপে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে মানুষ। কিন্তু মানুষ মানুষই, রেশম কীট নয়। সামগ্রিকভাবে মানুষকে দু-চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত করছে যে শক্তি সে হলো মানুষের শ্রম, সাধনা, জ্ঞান এবং বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের পথ ধরে চিন্তা করলে মানব-সভ্যতার নতুন প্রত্যুষের কল্পনা করে চাঙ্গা হয়ে ওঠা যায়, আবার দান্তের নরকেও অবতরণ করা যায়। কোন পথ কাঙ্ক্ষিত?