বিষয়কে ধরে দেখা, ছুঁয়ে দেখার ইংরেজসুলভ প্রাকটিক্যালিটি তাকে হেগেলের দর্শনের স্বর্গীয় উন্মাদনা থেকে রক্ষা করেছে। বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক তত্ত্বের নিরিখে বার বার প্রায়োগিক দিকটি যাচিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। বলতে হয় তার দর্শনের এই ভঙ্গিটি তাকে করে তুলেছে সংশয়বাদী। প্রশ্ন না করে বিচার না করে কোনো কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নন। শুরুতে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখেছেন বলে লোকে ভুল বুঝেছে, কিন্তু মনটা বাঁকা ছিল না। রাসেলের দর্শনটি নমনীয় নয়। মানুষকে জ্ঞানী, বিচারশীল এবং সহনশীল করার মোক্ষম অস্ত্র। জ্ঞানী করা এবং হয়ে ওঠা এক নয়। শুধু কেতাবের বিষয় হলে দর্শন এবং দার্শনিক দুয়ের সম্মান অটুট থাকে। দৈনন্দিন জীবনের বাঁকাচোরা, ব্যক্তিক, জাতিক, আন্তর্জাতিক সমস্যার সামনে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকতে হলে দর্শন এবং দার্শনিক দুয়েরই ভাগ্যে গালমন্দ এমনকি শাস্তি পর্যন্ত জোটে। রাসেলেরও তা জুটেছে। তার দেখার দৃষ্টিতে যা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন রকম। তাই রাসেলকে মত বদলাতে হয়েছে। তার অভিপ্রায় ছিল মানুষের অন্তরের সত্য এবং জগতের সম্বন্ধে একটা স্থির সিদ্ধান্ত টেনে আনা। তাতে করে সাধারণ মানুষ তার চিন্তার সূত্র ধরতে পারেনি। অনুরাগী এবং বন্ধুজনের কাছেও রাসেলকে বিদঘুঁটে মনে হয়েছে। বস্তুত তিনি অঙ্ক, নীতিশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র এবং মনোবিজ্ঞানের নীতি মাংসল মানুষের জগতে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। ঐ সকল শাস্ত্রে রাসেলের সিদ্ধান্ত অনেক বেশি সময় কার্যকরী। দলমত নির্বিশেষে অনেকেই মনে করেন, বিশেষ বিষয়ে তার মতামত অনেক বেশি মূল্যবান এবং তা যে টেকসই হবে দ্বিমত পোষণ করার মানুষ খুবই স্বল্প । উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে উদারনৈতিক রাসেল স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে ধারণায় এসেছেন মার্কসবাদী ক্রিস্টোফার কডওয়েলও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
এখানে একটা জিনিস ভেবে দেখার রয়েছে। অন্যান্য নামকরা ব্রিটিশ মার্কিন বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক যেখানে আপোস করে খানাখন্দের মধ্যে অঘোষিতভাবে তলিয়ে গেলেন, অনুরূপ অবস্থায় রাসেল এগিয়ে আসতে পারলেন কেন? ডি.এইচ. লরেন্সের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি খনি মজুরের ছেলে। লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিতজনের প্রতি তার সমবেদনা অনেক বেশি বাস্তব এবং ঘনীভূত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি হলেন, ফ্যাসীবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং হাতুড়ে সুলভ যৌন সর্বস্বতাবাদের প্রবক্তা। আমাদের গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। সে সন্দেহ রাসেলকে সহজ বিশ্বাসী হতে দেয়নি- কঠিনের পূজারী করেছে তার বলেই রাসেল বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। পক্ষান্তরে লরেসের মধ্যে চিন্তা ছিল না, ছিল সংবেদনা অনর্গলিত পথেই তীব্র বেগে গ্যাসের মতো বেরিয়েছে। রাসেলের ভুলচুক আছে কিন্তু তিনি চলমান মানব। তার জীবনপথের ধ্রুব নক্ষত্র দুটি। এক সত্য, অন্য স্বাধীনতা। সত্য বলতে চ্যাপ্টা এবং গোলাকার যুগপৎ, সে রকম কোনো পদার্থ নিশ্চয়ই রাসেল মনে করতেন না। সত্য চলমান, সত্য সজীব, সত্য বাঁচার আনন্দে কবির কাব্যে, বিজ্ঞানীর গবেষণায়, শ্রমজীবী মানুষের ঘাম শ্রম সংগ্রামে নিত্য মুকুলিত হচ্ছে।
জ্ঞান এবং জীবনকেও তিনি দেখেছেন একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষের জীবনের চারধারে যে অদেখা অন্ধকার কুহক সৃষ্টি করে, জ্ঞানের শাণিত তলোয়ারে হত্যা করে জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন প্রবাহিনী নদীরূপে। জীবন সুন্দর হবে, সুখী হবে, বলিষ্ঠ, ভাবনাসমৃদ্ধ হবে এবং আকাশের আয়তনে মাথাতোলা সবল ওকগাছের মতো বাড়বে; তাই তিনি জ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে কারাগার থেকে লেখা একটি চিঠিতে তা কিভাবে ধ্বনিত হয়েছে তার অংশবিশেষ উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
I want to stand at the rim of the world and peer into the darkness behind and see a little more than others have seen of the strange shapes of mystery that inhabit behind that unknown night. I want to bring back into the world of men some little bit of wisdom. There is a little bit of wisdom in the world. Heraclitus, Spinoza and a saying here and there. I want to add to it, even if only ever so little.
এই কথা কটির মধ্যে রেনেসাঁ যুগের শিল্পী মিকালেঞ্জেলোর আদম মূর্তির সম্মোহিত তরুণের স্বপ্নময়তার সঙ্গে যে বলিষ্ঠ বাসনা ফুটে বেরিয়েছে- তেমন একজন মানুষের বুকের হৃদ্স্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়। যার কামনা প্রথম মানুষটির মতো অবশ্য বাইবেলীয় অর্থে নয়। তিনি পুরনো কোনোকিছুতে নির্ভর করতে চান না। অতীতের জ্ঞানীরা ধ্যান-দৃষ্টিতে যা দেখেছেন তার বাইরে দেখতে চান, বাড়াতে চান নিজের পৃথিবীর সীমানা। সে দেখা শুধু রাসেলের দেখা নয়- তার যুগ, তার জেনারেশনের দেখা। তাই যতই দিন যাবে রাসেল স্বচ্ছ হয়ে উঠবেন।
রাসেলের আত্মকথার পাঠকের দুটি নেহায়েত মামুলি টুকিটাকির প্রতি দৃষ্টি পড়তে পারে। প্রথম যৌবনে তিনি খ্যাতি, প্রতিপত্তি কিছু কামনা করেননি। শুধু চেয়েছিলেন সন্তানের জনক হতে। একেবারে আদিম কামনা। জুলু হটেন্টটের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। প্রথম সন্তানের জনক হওয়ার সংবাদ এমন বিভোর আনন্দে পরিবেশন করেছেন নেহায়েত জৈবকর্মে বিরক্ত মানুষের মনেও একঝলক দখিনা হাওয়া সমীরিত হয়। এই মানুষী আবেগটিই রাসেলের অমরত্বের কারণ। তিনি বিশাল পুরুষ, বিখ্যাত মানুষ। কণ্ঠস্বর আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পাঁচ মহাদেশের কানে কানাকানি করে। এমন বিখ্যাত মানুষের আনন্দিত হওয়ার জন্য সুগায়কের গানের একটি কলি, জাতশিল্পীর ছবির একটু দর্শন, সবুজ বনানীর একটু অন্তরঙ্গ নিবিড় ছোঁয়া এই-ই যথেষ্ট। হাসি পাওয়ার মতো সাধারণ। সমস্ত অসাধারণেরাই অতিবেশি সাধারণ, কথাটি বোধকরি সত্য।