উনবিংশ শতকের শেষ দশকে অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজে রাসেল ছাত্র হয়ে আসেন। তার পাঠ্য বিষয় দর্শন। তিনি জার্মান ক্লাসিক্যাল দর্শনের শিরোমণি হেগেলের রচনার সংস্পর্শে আসেন। নব্য হেগেলীয়দের বিশিষ্ট একজন হিসেবে খুব শিগগির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন মার্কস এঙ্গেলসের উদ্ভাবিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের রূঢ় কঠোর আঘাতে গোটা মহাদেশে হেগেলীয় দর্শন অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছিল। মার্কসীয় চিন্তার প্রভাবে জার্মানি প্রভৃতি দেশে সংঘবদ্ধ শ্রেণীভিত্তিক আন্দোলন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। রাসেল যেহেতু শৈশবে খুবই নিঃসঙ্গ থেকেছেন, সম্ভবত সে কারণে শিগগিরই হেগেলের দর্শনের বাক সর্বস্বতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন। ঝুঁকলেন অঙ্কের দিকে। তখন কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকায় নতুন যান্ত্রিক দর্শন এবং মরমী দর্শনের স্ফুরণ হতে লেগেছে। রাসেলের যৌবনেই কাইজারের জার্মানি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাবৎ ইউরোপীয় শক্তি সে যুদ্ধে এপক্ষ ওপক্ষে অংশ নিয়েছে। লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা জারের রাশিয়ায় সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এ সমস্ত বিষয় একযোগে রাসেল মানুষটির অন্তর্লোকে রেখেছে গভীর অনপনেয় স্বাক্ষর।
উপরের ঘটনাপ্রবাহ ও ভাবনাস্রোতের নিরিখে রাসেল চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তার মহত্ব বিরাটত্ব বুঝতে পারব এমনকি তার অসঙ্গতিগুলোও বিচার করতে পারব। প্রথমত তিনি ইংরেজ। ইংরেজরা বিপজ্জনক রকমের প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। সম্ভবত ভুয়োদর্শনের প্রতি অধিক ঝোঁকের কারণেই সমস্ত ইংরেজ জাতি একজন প্রথম শ্রেণীর চিত্রকর এবং এক হবস্ বাদে কোনো বিশাল কল্পনার দার্শনিক সৃজন করতে পারেনি। বস্তুর প্রতি মোহ এবং অবারিত কল্পনার প্রতি সন্দেহসূচক দৃষ্টিভঙ্গি ইংরেজ জাতের একচেটে রাসেলেরও তা আছে। আত্মকথার গোড়ার দিকে তিনি তা স্বীকার করেছেন; ভিক্টোরিয়া যুগের বনেদী ইংরেজের রুচি তার চরিত্রের গড়নে রেশমী বস্ত্রের সুন্দর কারুকর্মের মতো ফুটে রয়েছে। নানা পরিবর্তন রূপান্তরের মধ্যেও রঙছুট হয়নি। আর সে যুগে দার্শনিকেরা মনে করতেন যুক্তির মাধ্যমে সমস্ত কিছুর সমাধান সম্ভব। তাকে তাও প্রভাবিত করেছে। শ্ৰেণীগতভাবে তিনি অভিজাত ছিলেন, কতেক কোমল মানবিক অনুভূতি এবং মানুষোচিত হৃদয়বৃত্তির অধিকারী হতে পেরেছিলেন। বুর্জোয়ার নগদ টাকার সম্পর্কে এ সম্বন্ধের উপর প্রচণ্ড একটা আঘাত হেনেছে। অভিজাত কুলে জন্ম চিরকালের জন্য তার বিপজ্জনক বিপ্লবী হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই দেখা গেছে চূড়ান্ত সময়ে যখন ঘটনাস্রোত অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করা অপরিহার্য করে তুলেছে তখনো রাসেল দুরূহ পরিশ্রম করে যুক্তি বের করে আনছেন। যে যুক্তি রাসেলের জন্য সত্য ছিল পৃথিবী তা গ্রহণ করেনি। ঘটনা ঘটেছে নিজের নিয়মে। রাসেলকে পুরনো যুক্তি আবার নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়েছে। ঘটনাস্রোতের বেগ বার বার যুক্তির গোছালো সুতো আউলা করেছে। বুদ্ধির ভাষা বোঝেন এমন সব মানুষও বিভ্রান্তিতে পড়েছেন, এখানেই রয়েছে তাকে ভুল বোঝার উৎস।
কৈশোরের নিঃসঙ্গতা নিঃসন্দেহে তার মনে প্রশ্নশীলতার বীজ বপন করেছিল। ট্রিনিটি কলেজের জ্ঞানের উত্তাপিত আবেষ্টনীর মধ্যে তার সবল অঙ্কুরণ লক্ষ্য করার মতো। রাসেলের সৌভাগ্য তিনি অনেকগুলো যুগান্তকারী প্রতিভার সঙ্গে মানসিক আলিঙ্গন করতে পেরেছিলেন। দার্শনিক জি. ই. মুর, অর্থনীতিবিদ কিস্ এবং আরো অনেক যুগন্ধর প্রতিভা তার বন্ধু ছিলেন।
আশ্বস্ত প্রতিবেশ যুবকের লজ্জা কেড়ে নিল, সে সঙ্গে নিল আল্লাহ এবং খ্রিস্টধর্মের প্রতি আস্থা। ভেতরের স্বেচ্ছাচারী শক্তি নিজের পথ কেটে প্রবাহিত হলো। হেগেলের ইতিহাসের দর্শনকে তো অগ্রাহ্য করলেনই এমনকি অন্যান্য দার্শনিকের ওভারকোটেও আত্মগোপন করলেন না। তার অন্দ্ৰি সন্ধান শিগগির জগতকে দেখার, বোঝার, বিচার করার, ঘটনা ব্যাখ্যা করার নিজস্ব একটা ভঙ্গি উদ্ভাবন করল।
আনাড়ির চোখেও ধরা পড়বে জার্মান ক্লাসিক্যাল দর্শন থেকে তিনি কতটুকু সরে এসেছেন। রাসেলের দর্শনে মৌলিক অবদান, থিয়োরি অব ডেসক্রিপসনের বিবরণ অল্প কথায় দেয়া সম্ভব নয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়ের একটা প্রাথমিক ধারণা মাত্র দেয়া যেতে পারে। ধরুন, একটা চোখ। তার বিশেষ আকার, বিশেষ গড়নভঙ্গি আর রয়েছে যান্ত্রিক নির্মাণশৈলী । সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির প্রভাবে বাইরের আলোকের প্রতিফলনে সক্ষম। যে যন্ত্রটির মাধ্যমে সম্পাদন করে এ প্রতিফলন কর্ম তাকে বলা যেতে পারে অক্ষিগোলক। এর প্রতিফলন কর্মকেই আমরা বলি দেখা। কিন্তু হেগেলীয় দর্শন চোখকে দেখবে অন্যভাবে। চোখের কোনো আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার না করে বলবে চোখ মানব শরীরের একটা অংশ। ব্যক্তি মানুষ আবার সমাজ মানুষের একটি অংশ। সমাজ যখন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় তখনই আসে সাবালকত্ব। তার মতে রাষ্ট্র মানুষের হাতে গড়া ঐশী প্রেরণার শ্রেষ্ঠ প্রতীক। ওখানে তিনি থামেননি। বিষয়টি অনেকদূর গড়িয়ে নিয়ে গেছেন। জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ ক্ষতিকর নয় বরং লাভজনক। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমেই ঐশী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবে । হেগেল জীবনে প্রাশিয়ার বাইরে যাননি, তাই জার্মান রাষ্ট্রকেই বিশ্বরাষ্ট্র বুঝতেন। এখনো হয়নি হওয়ার পথে। প্রমাণ করার জন্য বিরাট বিরাট কেতাব লিখেছিলেন। তার একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশ ছিল দর্শনের অন্তরালে, সম্রাট অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে যদি যুদ্ধ ঘোষণা করেন তাহলে শিগগির বিশ্বরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। বলা বাহুল্য, সে কর্মটি কাইজার এবং হিটলার উভয়ে করেছিলেন। হেগেলের দর্শন নিঃসন্দেহে প্রকাণ্ড মানব চিন্তার প্রকাশ। কিন্তু রাসেলের সে চোখের ব্যাপারটির কোনো সমাধান নেই তাতে।