বাংলাদেশে একটি নতুন রেনেসাঁর সূত্রপাত হতে চলেছে। চারিদ্র্যের দিক দিয়ে উনিশ শতকের কলকাতা শহরকেন্দ্রিক বাংলার যে প্রাণজাগরণ তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। বস্তুত সকল রেনেসাঁর মধ্যে একটা ভাবগত সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় । মানুষের মানুষী অস্তিত্বের নতুন মূল্যায়ন; ধর্মীয় সামাজিক ইতিনেতি সকল সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে জীবনের প্রকৃত সংজ্ঞায়নই হলো রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্য। সূর্যের নিচে মানুষের সমাজের প্রকৃত স্থান কোথায় শিল্প সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের নিরিখে আবিষ্কার করে মানুষের চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন সাধন করাই রেনেসাঁর কাজ। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অন্ধকারে সংলপ্ত ইউরোপে এমনটি ঘটেছে। এমনটি ঘটেছে উনিশ শতকের বাংলায়। বৃক্ষ সমাজের মতো অনড় অটল বাঙালি সমাজ থেকেই বেরিয়ে এল প্রতিভার মিছিল। বেরিয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন ধরনের মানুষ। বুকে বিদ্রোহের ধিকিধিকি আগুন, চোখে নতুন আকাক্ষার ঝলকানি, মাথায় নতুন একটি জগৎ সৃজনের পরিকল্পনা। এখন আমরা যে সময়টিকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে থাকি রেনেসাঁর প্রেরণায় তার আঁশ শাষ পুষ্ট, হৃৎপিণ্ড ধমনীতে ছন্দায়মান নতুন জীবনবোধের প্রেরণা।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ জগতের শুদ্ধভাবের বিকাশের ক্ষেত্রে, পশু মানুষকে বোধসম্পন্ন উন্নত দেবধর্মী মানুষ হিসেবে রূপায়ণে, জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টিতে, শিল্পকলার লাবণ্য সঞ্চারের মধ্য দিয়ে যন্ত্রবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিদ্যায় উৎকর্ষ সাধনে, শিল্পবিপ্লবে, সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের রাজ্য বিস্তার, পরবর্তীকালে রুশ বিপ্লব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এশীয় দেশের সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক বিপ্লবে অনেক কিছুই দান করেছে। উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁ অন্তত কতিপয় বাঙালি মনের সংস্কার মুক্তি সাধন করেছে। তথাকথিত প্রাচ্য দর্শনের বর্বর অন্ধকার ঠাসা মনকে বাংলার কতিপয় মানুষ উনিশ শতকের শুরু থেকেই জ্ঞানের প্রখর সূর্যের আলোর দিকে ফিরিয়েছিলেন। তার কথা শিক্ষিত সংস্কৃতিবান বাঙালির কাছে নতুন করে বলে লাভ নেই। বাঙালি ধর্মীয় মোহ ছেড়ে সাহিত্য সৃজনে মন দিল। সে সাহিত্য কালের কণ্ঠে ইন্দ্রমনির হারের মতো অনেকদিন দুলবে । বাঙালি কালাপানির সীমানা ডিঙিয়ে গেল। বাঙালি বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকল, বাঙালি নতুন সমাজ রচনায় ব্রতী হলো, নতুন রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপনের জন্য শক্তি নিয়োগ করল । আজকের বাংলা কেন, স্থূল অর্থে সমগ্র ভারতে যা হয়েছে তা উনিশ শতকের বাংলার, রেনেসাঁসের প্রেরণা থেকেই সম্ভাবিত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি প্রতিশ্রুতিবান সকালের তেজীয়ান সূর্য যেমন অপরাহে ক্লান্ত ছায়া মেলে দেয়, তেমনি প্রতিটি রেনেসাঁর আলোকতরঙ্গও নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অন্ধকারের সাগরে অবগাহন করে । রেনেসাঁর মূলমন্ত্র জ্ঞানই শক্তি বিকশিত হওয়াই জ্ঞানের ধর্ম। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক, শ্রেণীগত, জাতিগত অহংবোধে পীড়িত মানব সমাজ জ্ঞানকে সেবাদাসী করতে গিয়ে নিজের সমাধি রচনা করেছে। আলোকিত গ্রিসকে দাসভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা হত্যা করেছে, সুসভ্য ইউরোপকে ধনতান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থা কোণঠাসা করে এনেছে। উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁসের প্রাণসম্পদ এবং ভাবসম্পদ এখন অবসিত হয়ে এসেছে। আমরা আজ উনিশশ বাহাত্তর সালের শুরুতে দাঁড়িয়ে এ কথা যদি বলি, আশা করি অন্যায় করব না।
বাংলাদেশে যে একটি নতুন রেনেসাঁ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অনেকদূর। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিপূর্ণ এবং সুবলয়িত। কেননা উনিশ শতকের রেনেসবোধের বিকাশ হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের লৌহ কাঠামোর অভ্যন্তরে । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কখনো চায়নি সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ হোক। তাই উনিশ শতকী রেনেসাঁ অনেকগুলো বিশ্ববিশ্রুত মনীষার সৃষ্টি করলেও সমাজের সাধারণ মানুষকে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষকে জ্ঞানের ভোজে আমন্ত্রণ জানায়নি এবং সুন্দর জীবনবোধে উদ্দীপিত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে নবজাগরণের যে ক্ষেত্র আভাসিত হয়েছে তাতে কোনো বিধি-নিষেধের বালাই নেই। বাংলাদেশের গণসংগ্রামের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়, জ্ঞান সমাজের সকল মানুষের জন্য এবং সকল মানুষের সুন্দরের বোধে উদ্দীপিত হওয়ার অধিকার জন্মগত। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর, সকল স্তরের মানুষ গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে, প্রাণ দিয়ে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, সুন্দর উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, সমৃদ্ধ মানবসমাজ সৃজন এবং নতুন একটি দীপ্ত ধারার সভ্যতা নির্মাণ করার জন্য নিজের যা কিছু মূল্যবান বিসর্জন দিতে পারে।
বাংলাদেশের গণসংগ্রামকে কেউ কেউ বলেছেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন, কেউ কেউ বলেছেন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর । এসবের কতটুকু সত্যি কতটুকু মিথ্যা সে বিষয়ে আলোচনা না করেও একটি কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালি জাতি নিজে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিল, ইতিহাসে বাংলা ভাষা এই প্রথম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেল। এটা আপনি আপনি ঘটেনি। যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে তার জুড়ি নেই। এজন্য বাংলার প্রতিটি মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত কারণেই গর্ববোধ করতে পারে। এই গর্ববোধই বাংলাদেশে নবযুগ এবং নবজাগরণের গতি-প্রকৃতি বেগ আবেগ সঞ্চার করবে। এ ফাঁকা আশাবাদ নয়। কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদও নয়। ইতিপূর্বে লড়য়ে হিসেবে বাঙালিরা সুদক্ষ এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার কোনো সুযোগ-সুবিধা জাতি হিসেবে পায়নি। যখনই প্রয়োজন বাধ্য করেছে তাদেরকে, বলতে গেলে খালি হাতেই লড়াই করতে হয়েছে এশিয়ার একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীর সঙ্গে। বন্ধু দেশগুলো সাহায্য করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু একটি সমগ্র জাতির স্বাধীনতার জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মরণের এই যে সরল এবং বীরত্বব্যঞ্জক প্রস্তুতি তা না থাকলে কোনো সাহায্যই কাজে আসত না। প্রয়োজনের তাগিদেই বাঙালিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস দর্শনেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতেই হবে। এ কঠিন কাজ। কিন্তু নতুন ইতিহাস সৃজনের কোনো সহজ পন্থা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আগে অভাব যে পরিমাণে বোধ করেছি এখন তা একশ গুণ বেশি তীব্রভাবে অনুভব করছি। কারণ দাসজাতির অভাব অল্প, তার ক্ষমতাও অল্প। আমরা আমাদের ক্ষমতা উপলব্ধি করেছি এবং অভাবটাও তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করছি। গলদ কোথায় ধরতে পারছি। আগে আমরা কিসে আমাদের মঙ্গল এবং কিসে আমাদের অমঙ্গল ভাবতে পারতাম না। এখন সে বাধা অপসারিত। তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসন একটা দুঃস্বপ্ন। এখন থেকে সচেতনভাবে, সক্রিয়ভাবে আমাদের মঙ্গলামঙ্গল বিবেচনা করতে পারব এবং অপরকে নিজের কল্যাণ ভাবনায় ভাবিত করে তোলার পথে কেউ বাধা দিতে হইচই করে ছুটে আসবে না। অন্য দশটি স্বাধীন সমৃদ্ধিশালী জাতির মতো আমরাও মাথা তুলে দাঁড়াবো। জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, প্রযুক্তিবিদ্যা কোনো দিকে কোনো জাতির চাইতে পিছিয়ে থাকব না। আমরা সমাজ এবং সমাজ আদর্শকে নতুনভাবে ঢালাই করব- যেমনটি আমাদের মন চায়, সাধ্যে কুলায়। জীবনবিরোধী সমাজবিরোধী সকল অন্ধ তামসিক শক্তির বিরুদ্ধে আমরা ক্ষমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা কারো মতো হব না, আমরা আমাদের মতো হব। আমরা কারো