মানুষ মাত্রেই কতেক সীমিত নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার চৌহদ্দী ডিঙানোর আকুতি যার মধ্যে যত বেশি প্রবল, পশুর সঙ্গে তার প্রভেদও তত স্পষ্ট অর্থাৎ তিনি অনেক বেশি মানুষ। ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করার এ অনিভন্ত উদ্দীপনাকে বলা যেতে পারে মানুষী সত্তার প্রমিথিয়ান রশ্মি । যারা অসাধারণ তাদের মধ্যে এ আগুন অনেক বেশি তেজোময়। চেতনার বলয়ে অন্তর্জানের বেশে যে শিখা অবস্থান করে তার আলোতে বস্তুজগৎ, সমাজ-জগৎ এবং মনোজগতের উত্তরণের ভাবী কটি ধাপ আগাম প্রতিফলিত হয়। বদ্ধ দরজার ফুটো দিয়ে তেরছা হয়ে যে কটি আলোকরেখা চোখে পড়েছে তার ওপাশে কি জানার জন্য, দেখার জন্য, অনুভব করার জন্য অন্তরাত্মা আকুল হয়ে ওঠে। শরীরের সমস্ত রক্ত পরামর্শ করে উজান যেতে চায়। এক ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর অস্থিরতা লোমকূপে রি-রি করে কাঁপে। কিন্তু মানুষ সবসময় তালা খুলতে পারে না। সব সময় রহস্যভেদ করতে পারে না, সমস্ত জীবনের উদ্যম প্রচণ্ড ব্যর্থতার অপঘাতে ধুলোকাদায় গড়াগড়ি করে। সুন্দরীর এলোকেশের মতো রহস্য জট পাকিয়ে যায়- অন্তরালের সুন্দরী ডাকে আয় আয়। মানুষ ছোটে তুরঙ্গম গতিতে। সীমিত বুদ্ধির পুঁজি নিঃশেষিত হয়, পথরেখার দুপাশে পড়ে থাকে সাদা হাড়, মাথার খুলি। সে পথে আবার যায় যাত্রী।
বস্তুত রহস্য ভেদ করবার জন্য যে ধরনের বলবান শীলিত বুদ্ধির প্রয়োজন তা অনেকের থাকে না, নানা কিছুই বুদ্ধির সতীত্ব হরণ করে। বংশক্রম, শ্রেণী, পেশা, জলবায়ু, দেশ, কাল, ধর্ম এবং রাষ্ট্র সবকিছু একযোগে বুদ্ধিবৃত্তির সতীত্ব নাশ করার মানসে ওঁত পেতে রয়েছে। সেগুলো চেকন চেকন লতার নাগপাশের মতো বুদ্ধির শীর্ষ এপাশে না হয় ওপাশে হেলিয়ে রাখে। স্বাস্থ্যপ্রদ সূর্যালোকে অভিসার করতে পারে না। এসব কিছুর দড়াদড়ি ছিঁড়ে বুদ্ধিকে প্রাকৃতিক সত্যের মতো করে বিকশিত করাই হলো বিজ্ঞানবুদ্ধি। মানুষ কি বিজ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী হতে পারে? প্রখর ইচ্ছে দিয়ে চেষ্টা করলেও পরিশীলন সে আনতে পারে? জন্ম এবং মৃত্যুর পরাক্রান্ত সীমানা মেনে নিয়ে কাজে নামতে হয়। তার জন্মের জন্য সে নিজে দায়ী নয়। যে মানুষের খেয়াল খুশিতে তার জন্ম তাদের কাছ থেকে পাওয়া রক্তধারার মধ্য দিয়ে সে তাদেরই সংস্কারের বীজাণু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে অসহায় মানব শিশু মা বাপ সমাজ সংস্কৃতি থেকে স্নেহ, প্রেম, রাগ, অনুরাগ, ক্ষোভ-দ্বেষ, বিদ্রোহ বিপ্লবের মাধ্যমে যা গ্রহণ করে, যেসব সংস্কারের জাল তাকে আটকে ধরে । জীবনকে বলা যেতে পারে চলিষ্ণু উদ্ভিদ। আবার আরেক নামেও ডাকা যায়- চিন্তান্বিত কামনা। এখন কথা দাঁড়ালো চিন্তান্বিত কামনা তরুর গতিবিধি কতদূর পর্যন্ত স্বকীয় চেষ্টা উদ্যম এবং শ্রমে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে মানুষ। শিয়রে তো মৃত্যু পরোয়ানা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীর্ঘ দিন সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে মেজে ঘষে অবচেতনকে চেতনের স্তরে এনে সত্য মিথ্যা পরখ করে দেখবে সে ফুল্ল অবসর কই? তবু মানুষ এ সংকীর্ণ সময়সীমার বাঁধনের মধ্যে নিজের বুদ্ধি এবং বোধির স্বরূপ যতদূর উপলব্ধি করতে পারে, সিদ্ধি ততদূর।
বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সীমিতি কতদূর এবং তা ভাঙার জন্য তার চেষ্টা কত বেশি শানানো এবং পরিকল্পনা কতদূর নিখুঁত– উপলব্ধির জন্য আশা করি উপরের কথা কটির প্রয়োজন আছে।
রাসেল জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের এক বনেদী পরিবারে। তার পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ কীর্তিমান ছিলেন। তার বাবা এবং এক জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়া পরিবারের সকলে ছিলেন আচারনিষ্ঠ খ্রিস্টান। খুব ছোট বয়সে রাসেল মা বাবা দুজনকে হারান। তাই পিতামহ এবং পিতামহীর আশ্রয়ে তাকে শৈশবকাল অতিবাহিত করতে হয়। তারা প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের শিক্ষায় তাকে শিক্ষিত করে তোলেন। রাসেলের চরিত্রে এবং ব্যক্তিত্বে খাঁটি খ্রিস্টানের কিছুটা রেশ রয়ে গিয়েছে তাই। সে সময়টা ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার আমল। ঐতিহাসিকেরা রাণী এলিজাবেথের যুগ থেকে ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকাল পর্যন্ত প্রসারিত সময়কে ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময়ে বাকি চারটি মহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। ইংল্যান্ডের যা গর্বের বস্তু শিল্পকলা, দর্শন এবং যন্ত্রশিল্প ঐ সময়েই বিকশিত হয়। অভিজাত শ্রেণীর ইংরেজ ভদ্রলোক যে জাতিক ও শ্ৰেণীক বীরত্বের ব্যঞ্জনা মধ্যদিনের অলস স্বপ্নে, বলনাচের আসরে অনুভব করতেন সে পরিবেশেই মানুষ হয়েছেন রাসেল। বুর্জোয়ার উন্মেষ যুগের স্বপ্ন কল্পনার উদ্দামতা যার শিল্প সংস্কৃতির শিরায় উপশিরায় তাজা শোণিতের মতো প্রবাহিনী ছিল; বর্তমান যুগে পটের স্থির চিত্রের মতো স্থবির নিশ্চল হতে পারে, কিন্তু তারও ছিল যৌবন দিন। রাসেল সম্পর্কে আরেকটি তথ্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। নইলে তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের আসল চেহারাটি ধরা নাও পড়তে পারে। তার বাবা ছিলেন নাস্তিক। তিনি উইলে লিখে গিয়েছিলেন, তার সন্তানদের শিক্ষা যেন ধর্মনিরপেক্ষভাবে দেয়া হয়। পরে এ সম্পর্কে অবহিত হলে রাসেলের মনে ঘোর প্রতিক্রিয়া হয়। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি নাস্তিকতা পেয়েছিলেন।