বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু-বছরে কিংবা চার বছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে।
বার্ট্রান্ড রাসেল
বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন ও মনীষার এক অংশ মাত্র সাধারণের চোখে পড়েছে। অপর অংশ চাঁদের অপর পিঠের মতো লোকলোচনের অন্তরালে রয়ে গেছে। গোটা পৃথিবীর মাত্র চল্লিশজন বিশারদ লোক নাকি ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়েছেন। তাদের সকলে যে রাসেলের সূক্ষ্ম চিন্তাপদ্ধতির সূক্ষ্ম তন্তু পুরোপুরি অনুধাবন করতে পেরেছেন এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেননি। দর্শনে তার নিজস্ব অবদান ‘থিয়োরি অফ ডেসক্রিপশন’ প্রসঙ্গেও এ কথা অতটা না হলেও অল্পবিস্তর খাটে। জনপ্রিয় রচনাসমূহ সাধারণ মানুষের কাছে এনেছে তাকে- একথা সত্য বটে। কিন্তু আসল রাসেল মানুষটিকে তার মধ্যে পাওয়া যাবে না। রচনারীতির সরল ভঙ্গি এবং ঋজু বক্তব্যের মতো মানবিক ভাবাবেগের শূরণের মাধ্যমে যেন জনসভায় জানান দিতে চেয়েছেন তাদেরই একজন তিনি। মনের গুঞ্জরণশীল ভাবনাগুলো আলাদা করে হেঁকে হেঁকে সঠিকভাষায় অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতাসহকারে তরজমা করতে পেরেছেন বলেই তিনি মোটামুটি ভাবনা চিন্তা করতে সক্ষম মানুষের মনেও একটা আসন অনেকটা জোর করে আদায় করে নিয়েছেন। লোকমনরঞ্জনের অভিপ্রায়ে তিনি লিখেননি। বরং বলা চলে অনেক সময়েই বেশির ভাগ মানুষের সংস্কার বিশ্বাস এবং চিন্তন পদ্ধতির উপর খুব তীক্ষ্ণ আক্রমণ চালিয়েছেন।
এখানে ধরা পড়ে রাসেলের লক্ষ্য করবার মতো একটি বিশেষত্ব। আক্রমণ করার যে একটা পালোয়ানী বা খেলোয়াড়ী উল্লাস থাকে, তা রাসেলের নেই। ব্যথিত হয়েছেন অনেক সময়, কিন্তু ধৈর্য হারিয়েছেন কম সময়। তার পছন্দ এবং অপছন্দের সীমানাও তিনি টানেন নিজের ভঙ্গিতে। কোনো কিছু মনঃপূত না হলে তিনি কারণ বলে দেন। বিষয়টি তার মনঃপূত নয়, যেহেতু তার ধারণাতে বিষয়টি মানুষের শরীর মনের সুস্থ বিকাশের অনুকূল নয়, যুক্তিগুলো থরে থরে সাজিয়ে বিন্যাস করে দেখাবেন। রাসেলের উইট হীরার ছুরি। ইচ্ছে করে কথা বলেন না, হঠাৎ কথা বলবার ঝেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। প্রচলিত অর্থে চমৎকার ধারালো ভারালোর কোনোটাই নয়। বার্নার্ডশ’র মতো ক্ষোভ মেশানো জ্যাঠামি দিয়ে লোক হাসানোর ইচ্ছা রাসেলের আদৌ নেই । তিনিও কিন্তু লোককে শিক্ষা দিতে চান। তাই বলে আগ্রহাতিশয্য তার নেই। মানুষের জানা প্রয়োজন, ইচ্ছে করলে মানুষ সত্যকে গ্রহণ করতে পারে। তাই রাসেলীয় উইট ঝিলিক দিয়ে বুকে বেঁধে কিন্তু মুখে হাসি আসার আগে মনে চিন্তার শিকড় বাড়িয়ে দেয়। তার অপছন্দবোধ আছে সেটা কঠিন এবং হিমশীতল, মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত স্পর্শ করে। কিন্তু ঘৃণা? সম্ভবত তা তিনি করেন না।
তার মতের পুরোপুরি বিরোধিতা করেছেন এমন মানুষও তার রচনারীতির প্রতি আকর্ষণ চেপে রাখতে পারেননি। তার বক্তব্য চতুর্মাত্রিক; তাতে স্পষ্টতার সঙ্গে তীক্ষ্ণতার মিলন ঘটেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই অর্জুনের মতো পাখির চোখ দেখে ফেলেন। কেউ তাকে গ্রহণ করুন না করুন ইচ্ছে- তার কাজ বিষয়টি ধরিয়ে দেয়া। তিনি কর্তব্যমাত্র পালন করছেন। অঙ্কবিদের নিখুঁত পরিপাট্যের সঙ্গে আরেকটি দুর্লভ গুণের মিশেল দিয়েছেন তিনি। যে গুণটি ধ্রুপদ সঙ্গীতের রস। বস্তুত সংখ্যার রোমাঞ্চ গাণিতিকের মনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমশ্রেণীর নিষ্কাম আবেগের জন্ম দেয়। কিন্তু তাদের অনেকেই এই গভীরতা সন্ধানী জাফরানের ঘ্রাণ এবং অনুভূতির লাবণ্য অপরের কাছে তুলে ধরতে পারেন না। কিন্তু রাসেলের পারঙ্গমতা সন্দেহের অতীত। তার মানবিক আবেগের স্পর্শলাগা রচনাগুলো পাঠের পর মনে রসিয়ে ওঠে ধ্রুপদ সঙ্গীতের করুণ মূৰ্ছনা। মন চারধারে আপনা থেকেই প্রকাশিত করে শান্তশীতল এলানো ছায়া। মরুভূমির মধ্যে উদ্যানকুঞ্জের মতো। বলতে সাধ হয় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, অঙ্কবিদ যাই হোক না কেন এই ঋজুরেখ চিন্তার অধিকারী ধাতব কঠিন মানুষটির মধ্যে এমন কেউ কোথাও একজন আছেন, যাকে সেক্সপীয়র, শেলীর জাতভাই বলতে পারি।
শুধু রচনারীতির উপর যাদের নাম ধাম খ্যাতি, রাসেল সে জাতীয় পুরুষ নন। সংসারের ঝড় ঝঞ্ঝায় প্রবল সামুদ্রিক তিমির মতো যুঝেছেন। তার অস্ত্রলেখা বীরত্বের প্রতাঁকের মতো সকল গতরে ছড়ানো রয়েছে। অর্ডসওয়ার্থ নিউটন সম্বন্ধে যা বলেছেন Voyazing alone in the Ocean of thought, রাসেলের ব্যাপারেও কথাটা লাগসই। তা ঠিক, রাসেলের আরেকটি দিকও রয়েছে। নিষ্ক্রিয় চিন্তাবিদের জীবন রাসেলের নয়। একা মহাসমুদ্রে পাড়ি দিয়ে মুক্তো মানিক তুলেছেন এমন অনেকে আছেন। শিগগির কিংবা দেরিতে তাদের অবদান মানব সমাজ গ্রহণ করেছে। রাসেল চিন্তানায়ক, একাকীত্বের বিষণ্ণ বেদনা অনেক চিন্তানায়কের প্রিয়তম সুহৃদ। চিন্তাভাবনার জগতে ক্ষ্যাপার পরশপাথর সন্ধান করেছেন তিনি। কিন্তু নিজে তিনি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন এমন একটা স্বর যা শুধু অরণ্যে আর্তনাদ করবে না। লোকালয়ে, নগরে-জনপদে, মানুষের নিবাসকুঞ্জে ধ্বনিত হবে সে স্বর নিটোল নিঝর আওয়াজের মতো এবং মানুষ দেবে তার সানন্দ উত্তর। মানুষের আবেগে চিন্তায় আসার আকুল আকুতি রাসেলকে প্যাচালো বিতর্কের পানে ঠেলে দিয়েছে।