.
৭.
বাঙালি মুসলমানরা শুরু থেকেই তাদের আর্থিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিলেন। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তনের কারণে তাদের মধ্যে একটা সামজিক প্রভুত্ব অর্জনের উন্মেষ হলেও জাগতিক দুর্দশার অবসান ঘটেনি। বাংলাদেশে নতুন নতুন রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আশাতীত হারে বৃদ্ধিলাভ করেছে। যেহেতু মৌলিক উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেনি, তাই রাজশক্তিকেও পুরনো সমাজ সংগঠনকে মেনে নিতে হয়েছে। সে জন্যেই মুসলিম শাসনামলেও বাঙালি মুসলমানেরা রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিগৃহীত ছিলেন। ইংরেজ আমলে উঁচু শ্রেণীর মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে সামাজিক নেতৃত্বের আসন থেকে বিতাড়িত হলে উঁচু বর্ণের হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই সে আসন পূরণ করে।
বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের লোক। তাদের মানসিকতার মধ্যেও আদিম সমাজের চিন্তন পদ্ধতির লক্ষণসমূহ সুপ্রকট। বার বার ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও বাইরের দিক ছাড়া তাদের বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দিনের পর দিন গিয়েছে, নতুন ভাবাদর্শ এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসনপদ্ধতি চালু করেছেন, কিন্তু তারা মনের দিক দিয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতোই বার বার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি মুসলমান এবং মুসলমান রাজত্বের সময়ে তাদের মানসে যে একটি বলবন্ত সামজিক আকাক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তাদেরই রচিত পুঁথিসাহিত্যসমূহের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। কাব্য সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে হয়তো এসকল পুঁথির বিশেষ মূল্য নেই, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজের নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় এসবের মূল্য যে অপরিসীম সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচের মতে প্রতিটি জাতির এমন কতিপয় সামাজিক আবেগ আছে যার মধ্যে জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্যাসের আকারে পুরোমাত্রায় বিরাজমান থাকে, রাজনৈতিক পরাধীনতার সময়ে সে আবেগ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে এবং কোনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে সে আবেগই ফণা মেলে হুংকার দিয়ে ওঠে। সাহিত্যেই এই প্রথমে জাতিগত আকাক্ষার রূপায়ণ ঘটতে থাকে। জাতিগত আকাক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে কোনো মহৎ সাহিত্য যে সৃষ্টি হতে পারে না, একথা বলাই বাহুল্য।
পুঁথিসাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙালি আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে। কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার, সে মন কোনো পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাসমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিল। সমাজ সংগঠন ভেঙে ফেলে নব রূপায়ণ তারা ঘটাতে পারেননি। কারণ মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে যে নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব একেবারে ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুন শাসকশ্রেণীর অভ্যাস, মনন রপ্ত করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালি মুসলমান।
ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পরে এই দেশে হিন্দুসমাজের ভেতর থেকে যে একটি মধ্যবিত্ত নেতৃশ্রেণী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার মধ্যে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব প্রায় না থাকার কারণ হিসেবে শুধু ব্রিটিশের ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসি’ কিংবা মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ইংরেজের অন্ধবিদ্বেষকে ধরে নিলে মুসলিম সমাজের তুলনামূলকভাবে পেছনে পড়ে থাকার কারণসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা করা হবে না ।
.
৮.
ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থান যুগে ইউরোপীয় ভাবধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নানা আধুনিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিন্তারাশি বঙ্গীয় হিন্দু সমাজের একাংশের মধ্যে যে তরঙ্গ তুলেছিল, তা মুসলমান সমাজকে স্পর্শও করতে পারেনি। আধুনিক যুগের দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে যে সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক মূল্যচেতনার নেতৃত্ব হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী দান করেছিলেন, মুসলমান সমাজে তা একেবারে প্রসার লাভ করেনি । জগৎ এবং জীবনের যে সকল অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্ন নবযুগের আলোকে তারা ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন, মুসলমান সমাজ তার কিছুই গ্রহণ করেনি। সে সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমির আলী, নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ যে সকল মুসলিম চিন্তানায়ক মুসলমানদের হয়ে কথা বলছিলেন এবং চিন্তা করছিলেন, মুসলমান সমাজের প্রকৃত দাবি কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে চিন্তা করার কোনো অবকাশই পাননি। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সংস্কার বলতে তাদের মনে প্রভুত্ব হারানো উঁচু কোটির মুসলমানদের কথাই জাগরুক ছিল।
স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে যে অধিকারচেতনা অপেক্ষাকৃত পরে জাগ্রত হয়, আসলে তা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের আন্দোলন এবং অগ্রগতির সম্প্রসারণ মাত্র। তাদেরকে তা করতে গিয়ে দু-ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। লেখাপড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থস্বার্থের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো এবং অন্যদিকে উঁচুতলার মুসলমানদের মূল্যচেতনা এবং জীবনদৃষ্টিকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। এই দু-মুখী প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করতে হলে যে শক্ত সামাজিক ভিত্তিভূমির প্রয়োজন ছিল,তাদের পেছনে ছিল না। তাই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে থেকেও ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ নিয়ে যারা উপরে উঠে আসতেন, উঁচুতলার মুসলমানদের জীবনদৃষ্টির সঙ্গে তারা নিজেদের সংযুক্ত করতেন। স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলন থেকে শুরু করে জামালুদ্দিন আফগানীর ‘প্যান ইসলামিজম’ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে আসা সমস্ত আন্দোলন প্রবর্তনার সঙ্গে নিজেদের অংশীদার করে নিতেন। কিন্তু স্যার সৈয়দের আলীগড় আন্দোলন একান্তভাবে উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের সংখ্যলঘিষ্ঠ মুসলমান সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। আবার এই সামন্তশ্রেণীর সঙ্গে জনগণের শ্রেণীগত তফাত ছাড়া ভাষা সংস্কৃতিগত পার্থক্য যে ছিল না একথা বিংশ শতাব্দীতেও ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানেরা খুব কমই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তারা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে অনুরূপ সমাজচেতনা এবং মূল্যবোধ সঞ্চারের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বাঙালি জনগণের সঙ্গে এতটা সম্পর্ক বিরহিত ছিল যে ভাবাদর্শিক কোনো জাগরণ আনতেই পারেনি। ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সংস্কারকে আঘাত করে এমন কোনো সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারেনি। মুসলমানদের দ্বারা সংগঠিত প্রায় সমস্ত সামজিক কর্মকাণ্ড এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণভিত্তিক।