প্রায়শ হালের একগুঁয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা বলে থাকেন, ব্রিটিশ শাসনের আমলে বাংলার মুসলমান সমাজ অধঃপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা পুরো সত্য তো নয়ই, সিকি পরিমাণ সত্যও এর মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। সত্য বটে, মুসলিম শাসনের অবসানের পর শাসক নেতৃশ্রেণীটির দুর্দশার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালি মুসলমান জনগণের একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো যোগসূত্র ছিল কি? আর মুসলমান জনগণের অবস্থা ইংরেজ শাসনের পূর্বে অধিক ভাল ছিল কি? নবাবী আমলেও এ দেশীয় ফার্সী জানা যে সকল কর্মচারী নিয়োগ করা হতো, তাদের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু কতজন ছিলেন এবং কতজন ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, এ সকল বিষয় বিচার করে দেখেন না বলেই অতি সহজে অপবাদের বোঝাটি ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্বমুক্ত মনে করেন।
উত্তর ভারতেও মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণী এইভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন, অধিকন্তু তাদের অনেকেই সিপাহী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার পরেও তারা কি করে এগিয়ে আসতে পারলেন এবং তাদের মধ্যে কেন সৃষ্টি হলো স্যার সৈয়দ আহমদের মতো একজন মানুষ। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে তেমন একজন মানুষ জন্মালেন না কেন? এই সকল বিষয়ে সদুত্তর সন্ধান করলেই বাঙালি মুসলমানের যে মৌলিক সমস্যা তার মূলে যাওয়া যাবে ।
বাঙালি মুসলমান কারা? এক কথায় এর উত্তর বোধকরি এভাবে দেয়া যায়: যারা বাঙালি এবং একই সঙ্গে মুসলমান তারাই বাঙালি মুসলমান। এঁদের ছাড়াও সুদূর অতীত থেকেই এই বাংলাদেশের অধিবাসী অনেক মুসলমান ছিলেন যারা ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যানুসারে ঠিক বাঙালি ছিলেন না। আর্থিক,সামাজিক এবং রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধাগুলো তাদের হাতে ছিল না বলেই বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে কৃষ্টি সংস্কৃতিগত ভেদরেখাসমূহ অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রভুত্বশীল অংশের রুচি, জীবনদৃষ্টি, মনন এবং চিন্তন পদ্ধতি অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল । বাঙালি মুসলমানের যে ক্ষুদ্র অংশ কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলে যখন সামাজিক প্রভুত্ব এবং প্রতাপের অধিকারী হতেন, তখনই বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চুকে যেত এবং উঁচু শ্রেণীর অভ্যাস, রুচি, জীবনদৃষ্টির এমনকি ভ্রমাত্মক প্রবণতাসমূহও কর্ষণে ঘর্ষণে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গীভূত করে নিতেন।
মূলত বাঙালি মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। এই অঞ্চলে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার পরে সেই যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, এদের হতে হয়েছিল তার অসহায় শিকার। যদিও তারা ছিলেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তথাপি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রশ্নে তাদের কোনো মতামত বা বক্তব্য ছিল না। একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তানদের এই সামাজিক অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছিল। যেমন কল্পনা করা হয়, অত সহজে এই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হতে পারেনি। বাংলার আদিম কৌম সমাজের মানুষেরা সর্বপ্রকারে যে ওই বিদেশী উন্নত শক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন- ছড়াতে, খেলার বোলে অজস্র প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষদের বাগে আনতে অহংপুষ্ট আর্য শক্তিকেও যে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তার বিশ্ববিশ্রুত ভারতের ধর্মসমূহ’ গ্রন্থে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। আর্য অথবা ব্রাহ্মণ্য শক্তি যে সকল জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করে এদেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তাদেরকে একেবারে চিরতরে জন্ম-জন্মান্তরের দাস বলে চিহ্নিত করেছে। আর যে সকল শক্তি ওই আর্য শক্তিকে পরাস্ত করে ভারতে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তাদের সকলকেই মর্যাদার আসন দিতে কোনো প্রকারের দ্বিধা বা কুণ্ঠা বোধ করেনি। শক, হুন, মোগল, পাঠান, ইংরেজ যারাই এসেছে এদেশে তাদের সকলকেই একেকটি মর্যাদার আসন প্রদান করেছে। রাজ্যবিস্তারে প্রশাসনে তাদের সহায়তা করতে পিছপা হয়নি। কিন্তু নিজেরা বাহুবলে যাদের পরাজিত করেছিল তারাও যে মানুষ একথা স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা খুব অল্পই অনুভব করেছেন । তবু ভারতবর্ষে এমনকি এই বাংলাদেশেও যে, কোনো কোনো নিচু শ্রেণীর লোক নানা বৃত্তি এবং পেশাকে অবলম্বন করে ধীরে ধীরে উপরের শ্রেণীতে উঠে আসতে পেরেছেন তা অন্যত্র আলোচনার বিষয়।
বাংলাদেশের এই পরাজিত জনগোষ্ঠী যাদেরকে রাজশক্তি পাশবিক শক্তির সাহায্যে অন্ত্যজ করে রাখা হয়েছিল, তাদেরই সকলে এক সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে সে প্রাথমিক পরাজয়ের কিঞ্চিত প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন । শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে প্রাচীন আর্য ধর্মের নব জীবন প্রাপ্তির পর বৌদ্ধদের এদেশে ধন প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো, তার অব্যবহিত পরেই এদেশে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা হয় এবং ভীত-সন্ত্রস্ত বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে। হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তারা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধু ব্রিটিশ শাসনের দুশ বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।