তদুপরি, এই ভারতবর্ষের লক্ষৌ, দিল্লি ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলামের যেটুকু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে বাংলা মুলুকে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছোতে পারেনি। যে মুসলিম শাসক শ্রেণীটি নানা সময়ে বাংলাদেশ শাসন করতেন, তারা সকলেই ছিলেন বিদেশী। রক্ত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তারা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক ফ্যাসান ইত্যাদির জন্যে দিল্লি কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন। এই উঁচুকোটির মুসলিম শাসকবর্গ যাদের হাতে অধিকাংশ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তারা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক নেতা ছিলেন না। এই উঁচুকোটির মুসলমান প্রশাসকেরা এদেশীয় যে শ্ৰেণীটির সহায়তায় বাংলাদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন,তারা প্রায় সকলেই ছিলেন স্থানীয় উঁচু বর্ণের বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈদ্য শ্রেণীর লোক। যখনই প্রয়োজন পড়েছে কিংবা ব্রাহ্মণ শ্ৰেণীর আনুগত্য সম্বন্ধে মনে সন্দেহ জেগেছে তারা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে খেলাত এবং পদবী বিতরণ করে আরেকটি নেতৃশ্রেণী সৃষ্টি করেছেন। ‘খাসনবীস,’ ‘মহলানবীস’, দেওয়ান’, ‘রায়রায়ান’, ‘বখসী’, ‘মুন্সী’, ‘দস্তিদার’ ইত্যাদি পদবীতেই তার প্রমাণ মেলে। বাংলার স্থানীয় মুসলমানেরা কদাচিত বিদেশী মুসলমান শাসকদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মে সহায়তা করার সুযোগ লাভ করেছেন। তার কারণ ছিল, একটি রাজশক্তির সঙ্গে সহায়তা করার জন্য যে পরিমাণ নিরাপদ আর্থিক ভিত্তির প্রয়োজন বাঙালি মুসলমানদের তা ছিল না। মুসলিম রাজশক্তি এই দেশের সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অতি সামান্যই রূপান্তর এনেছিলেন। তারা অনেকটা নির্বিবাদেই পূর্বতন সমাজ কাঠামোকে গ্রহণ করেছিলেন। পরিবর্তন ততটুকুই করেছিলেন, যতটুকু তাদের প্রয়োজন। অর্থাৎ পূর্বেকার শাসক নেতৃশ্রেণীর শূন্যস্থানটি তারা পূর্ণ করেছিলেন । মুসলিম শাসনের পূর্বে যে সমাজ ব্যবস্থাটি চালু ছিল, পরেও সেই একই ব্যবস্থা চালু থেকেছে। তার মধ্যে কোনো মৌলিক রূপান্তর বা পরিবর্তন তারা আনতে পারেননি। তাই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পরেও স্থানীয় মুসলমানেরা ইংরেজ আমলের দেশী খ্রিস্টানদের মতো একটা উন্মত্ত গর্ববোধ ছাড়া ইসলামি কিংবা আর্য সংস্কৃতির কিছুই লাভ করতে পারেনি। তাই খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মুসলমান আমলেও যারা প্রশাসনিক প্রয়োজনে গার্সী ভাষা শিক্ষা করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের উঁচু বর্ণের লোক। বাঙালি মুসলমানদের অবস্থার, পেশার এবং রুচির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি । ইসলাম গ্রহণের ফলে তারা কতিপয় মোটা অভ্যেস বর্জন করে কতিপয় মোটা অভ্যেসকে গ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু সংখ্যাগত দিক দিয়ে তারা ছিলেন অনেক,উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন এবং রাজশক্তি সময়ে অসময়ে তাদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন, এই সকল কারণের দরুন তাদের মধ্যে দ্রুত একটা সামাজিক আকাঙ্ক্ষা জন্মলাভ করেছিল। পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ দৈর্ঘ্যে মুক্তিলাভ করেছে।
.
৫.
এই পুঁথিসমূহের দো-ভাষী অর্থাৎ বাংলা এবং আরবী-ফার্সী মিশ্রিত হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান । হাদিসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবীকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো, কোরআনের ভাষা আরবী। দ্বিতীয় কারণ, বেহেশতের অধিবাসীদের ভাষা আরবী এবং তৃতীয়ত, হজরত মুহম্মদ নিজে একজন আরবীভাষী ছিলেন। এই তিনটি মুখ্য কারণে যে সমস্ত দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে এই ভাষাটিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আরব অধিকারের পূর্বে মিশর এবং আফ্রিকার দেশসমূহের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা দুই-ই ছিল। কিন্তু আরবদের অধিকারে আসার পর আরবী ভাষা এবং ইসলাম অনেকটা অভিন্নার্থক ছিল। আরবী ভাষাকে গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণ করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না, সে সময়ে এ রকম একটা প্রবল মত অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল। অন্য যে-কোনো সেমিটিক ধর্মের মতো ইসলামেও পারলৌকিক জীবনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সারা জীবন মুসলমান হিসেবে জীবন কাটিয়ে পরকালে বেহেশতে গিয়েও ভাষাজ্ঞানের অভাবে একঘেয়ে জীবন কাটাতে হবে এটা ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রেরই সহ্যের অতীত একটা ব্যাপার। তাই মিশর থেকে শুরু করে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা আরবী ভাষা এবং বর্ণমালা দুটিই গ্রহণ করেছিলেন।
মিশরে যেভাবে সহজে আরবী ভাষা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, ইরানে তেমনটি হতে পারেনি। কারণ ইরানীরা ছিলেন অতিমাত্রায় ঐতিহ্য-সচেতন এবং সংস্কৃতিগতপ্রাণ জাতি। তাদের মহীয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে এ যুক্তি উদ্ধার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি যে আরবী ভাষা না আয়ত্ত করেও প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়। কোরানের প্রকৃত শিক্ষা তাদের নিজস্ব ভাষায় বিকশিত করে তোলার মতো ভাষাগত সমৃদ্ধি এবং মনীষা দুই-ই তাদের ছিল । আরবী ভাষাকে গ্রহণ বর্জন প্রশ্নে ইরানী সমাজ যে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল,কবি শেখ সাদী, দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ তা গ্রহণ করেছিলেন । ইরানীরা আরবী ভাষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু আরবী বর্ণমালা তাদেরকে মেনে নিতে হয়েছে। তারপরে ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষ অবধি মুসলিম শক্তির যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে তার পেছন পেছন ফার্সী ভাষাও ভারতে প্রবেশ করেছে। এমনকি মোগল বিজেতারাও তাদের মাতৃভাষা তুর্কীর পরিবর্তে ফার্সীকেই সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। মিশরে আরবী যেমন, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে ফার্সী যেমন চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে, ভারতবর্ষে সেভাবে অনেক দিন রাজভাষা থাকার পরও ফার্সীকে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। ভারতের হিন্দুরা বড় আশ্চর্য জাত, তারা দরবারে চাকরি করার জন্য উত্তম রূপে ফার্সীভাষা শিক্ষা করেছেন, ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো’ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে কখনো ঐ ভাষাটিকে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভারতে ফার্সী ছিল জনগণের দৈনন্দিনতার স্পর্শলেশবর্জিত দরবারবিহীন একটি অভিজাত শ্ৰেণীর ভাষা। স্থানীয় মুসলিম জনগণের মধ্যেও তার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। স্বাতন্ত্রগর্বী মুসলমানেরা নিজেদের প্রয়োজনে ফার্সী বর্ণমালাকে গ্রহণ করে ভারতীয় ভাষা সমূহের সমন্বয়ে উর্দু নামে একটি পাঁচমিশালী ভাষা তৈরি করেছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যেমন রেনেসাঁর যুগে জাতীয় ভাষাসমূহের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পূর্বে ল্যাটিন ভাষাতে সন্দর্ভ ইত্যাদি রচনা করতেন, তেমনি মুসলিম ধর্মবেত্তারা ধর্মগ্রন্থসমূহের টীকাটিপ্পনী ফার্সী ভাষাতেই রচনা করতেন। সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলনের পর উর্দু ভাষাতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয় এবং ঐ ভাষাতেই ধর্মীয় সন্দৰ্ভসমূহ লেখা হতে থাকে।